বছর বছর বাড়ছে পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ বসতি

পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরে যেতে মাইকিং। গতকাল দুপুরে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার ইছাখালী গুচ্ছগ্রাম এলাকায়ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ধসের প্রাণহানি ঠেকাতে স্থায়ী উচ্ছেদ, পুনর্বাসনসহ নানা সুপারিশ রয়েছে। পাহাড় কাটা বন্ধে কঠোর ব্যবস্থার পাশাপাশি সবুজায়নের কথাও ছিল। কিন্তু এসব সুপারিশ কেবল কাগজেই। বছর বছর পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি বাড়ছে। এখন ভারী বর্ষণ হলে সাময়িকভাবে মাইকিং, বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়ার মধ্য দিয়ে দায়িত্ব শেষ করছে প্রশাসন ও পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি।

পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের বিভিন্ন পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতির সংখ্যা গত ১০ বছরে বেড়েছে ১০ গুণ। আর তিন পার্বত্য জেলায়ও পাহাড়ে বসতি গত সাত বছরে দ্বিগুণ হয়েছে।

গত রোববার আবহাওয়া অধিদপ্তর ভারী বৃষ্টি ও ভূমিধসের সতর্কবার্তা জারি করেছে। টানা বৃষ্টি হচ্ছে চট্টগ্রাম ও তিন পার্বত্য জেলায়। পাহাড়ধসের সতর্কবার্তাও দেওয়া হয়েছে। এবারও প্রশাসন সাময়িক ব্যবস্থায় আস্থা রেখে চলেছে। ঝুঁকিতে থাকা লোকজনকে সরে যেতে মাইকিং করছে। কিন্তু একজন বাসিন্দা সরেননি। প্রশাসনের সতর্কবার্তা কানেই তুলছেন বাসিন্দারা।

চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন পাহাড়ে গত বছর অবৈধ বসতির সংখ্যা ৬ হাজার ৫৫৮। এ বছর নতুন করে আর জরিপ হয়নি। তবে বসতি আরও বেড়েছে বলে মনে করছে প্রশাসন। এখন মোট ঝুঁকিপূর্ণ বসতিসম্পন্ন পাহাড় রয়েছে ২৬টি। অথচ ২০১৪ সালে ১১টি পাহাড়ে ৬৬৬টি পরিবার বসবাস করত।

গত ২১ জুন পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ২৮তম সভায়ও কমিটির আহ্বায়ক চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম ঝুঁকিপূর্ণ বসতি সরাতে কঠোর হওয়ার কথা বলেন। জানতে চাইলে তোফায়েল ইসলাম বলেন, ‘এতগুলো লোকের স্থায়ী পুনর্বাসন কঠিন। তারপরও সরকারি বিভিন্ন আশ্রয়ণ প্রকল্পে কিছু কিছু পুনর্বাসন করা হয়েছে। বৃষ্টি হলে আমরা পাহাড় থেকে লোকজনকে সরিয়ে নিচ্ছি। লোকজনের মধ্যে ভয়টাও কাজ করে না।’

২০০৭ সালে চট্টগ্রামে ভয়াবহ পাহাড়ধসের ১২৭ জনের মৃত্যুর পর ৩৬ দফা সুপারিশ দিয়েছিল তদন্ত কমিটি। এর ১০ বছর পর ২০১৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে ১৬৮ জনের মৃত্যুর পর ৩৫ দফা সুপারিশের মধ্যেও একই ধরনের সুপারিশ ছিল। কিন্তু বৃষ্টি হলে কিছু লোকজনকে সাময়িক সরিয়ে নেওয়া ছাড়া কার্যত কোনো সুপারিশই বাস্তবায়ন করতে পারেনি প্রশাসন।

চট্টগ্রামে বসতি ৬০০ থেকে ৬ হাজার

জেলা প্রশাসনের হিসাবে চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন পাহাড়ে গত বছর অবৈধ বসতির সংখ্যা ৬ হাজার ৫৫৮। এ বছর নতুন করে আর জরিপ হয়নি। তবে বসতি আরও বেড়েছে বলে মনে করছে প্রশাসন। এখন মোট ঝুঁকিপূর্ণ বসতিসম্পন্ন পাহাড় রয়েছে ২৬টি। অথচ ২০১৪ সালে ১১টি পাহাড়ে ৬৬৬টি পরিবার বসবাস করত।

পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির তথ্য অনুযায়ী, নগরের আকবর শাহ থানার ১, ২ ও ৩ নম্বর ঝিলসংলগ্ন পাহাড়ে সবচেয়ে বেশি ৪ হাজার ৪৭৬টি পরিবার ঝুঁকিপূর্ণ বা অবৈধভাবে বসবাস করছে বলে উল্লেখ করা হয়। এই পাহাড়গুলোর মালিক রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল। কিন্তু রেলওয়ে এসব পাহাড় রক্ষায় কোনো ব্যবস্থা নেয় না বলে অভিযোগ।

২০২২ সালের ১ নম্বর ঝিলে পাহাড়ধসে মারা গিয়েছিলেন একই পরিবারের দুজন। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, রেলসহ বিভিন্ন সংস্থাকে বারবার চিঠি দিয়েও তাদের নিজেদের পাহাড় রক্ষায় তৎপর করা যায়নি। ফলে বসতি বাড়ছে। আর পাহাড় কাটা ও বসতি স্থাপনে কাদের ইন্ধন রয়েছে, তা তো সবার জানা।

তিন জেলায় ঝুঁকিপূর্ণ বসতির তালিকাই নেই

২০১৭ সালে পাহাড়ধসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাঙামাটি। তখন এই জেলায় পাহাড়ধসে মারা যায় ১২০ জন। কিন্তু এ ঘটনার পর তদন্ত কমিটির যে সুপারিশ ছিল, তার কোনো বাস্তবায়ন নেই। এমনকি পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বাসিন্দা নিয়ে কোনো জরিপও নেই। তখন ক্ষতিগ্রস্ত হয় রূপনগর, নতুনপাড়া, শিমুলতলী, পশ্চিম মুসলিমপাড়া ও ভেদভেদী। তিন বছর আগে এই পাঁচ এলাকার ৩১ স্থানকে অতিঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে জেলা প্রশাসন সাইনবোর্ড দেয় জেলা প্রশাসন। তবে বিভিন্ন দপ্তরের হিসাবে এসব এলাকায় ২০১৭ সালের চেয়ে অন্তত ৫০০ ঝুঁকিপূর্ণ বসতি বেড়েছে।

বান্দরবানে ২০১৭ সালে পাহাড়ধসে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। সবশেষ গত শনিবার জেলাটির নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় পাহাড়ধসে একজন মারা যায়। কিন্তু জেলাটিতে নতুন করে ঝুঁকিপূর্ণ বাসিন্দার কোনো তথ্য বা জরিপকাজ হয়নি। ২০১৭ সালে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি ছিল ১ হাজার ৪৪৪টি পরিবার। এর মধ্যে পৌরসভাসহ লামা উপজেলায় ৪৫০ পরিবার, নাইক্ষ্যংছড়িতে ৩২৩, পৌরসভাসহ বান্দরবান সদর উপজেলায় ২৩২ পরিবার, রোয়াংছড়িতে ৫৯, আলীকদমে ২১৩, রুমায় ৮৩ ও থানচিতে ১০৮টি পরিবার ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসবাস করে। কিন্তু এই সাত বছরে ঝুঁকিপূর্ণ বসতির সংখ্যা বেড়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

খাগড়াছড়ি জেলাও পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ বাসিন্দার সংখ্যা নিয়ে কোনো জরিপ নেই। জেলা প্রশাসনের ধারণা অনুযায়ী ৯টি উপজেলায় এক হাজারের বেশি বসতি রয়েছে। ভারী বৃষ্টির সতর্কবার্তা দিলে তাদের সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। জেলা প্রশাসক মো. শহীদুজ্জামান বলেন, সহস্রাধিক বসতি পাহাড়ের ঝুঁকিতে রয়েছে। দুর্যোগের সময়ে তাদের সরিয়ে নেওয়া হয়।

যা ছিল সুপারিশে

পাহাড়ধসের পর গঠিত বিভিন্ন তদন্ত কমিটির সুপারিশে ছিল পাহাড় কাটায় জড়িত প্রভাবশালী ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও সংস্থার দুর্বৃত্তায়ন কঠোর হাতে আইনানুগভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। ন্যাড়া পাহাড় বনায়ন, পাহাড় কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের, পাহাড়ি এলাকায় শহর সম্প্রসারণ নিরুৎসাহিত করাও ছিল। কিন্তু এসব উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, আদালতের বিভিন্ন আদেশে চট্টগ্রামসহ সারা দেশের পাহাড় কাটায় নিষেধ রয়েছে। তারপরও এই নির্দেশনাগুলোর সঠিক প্রতিপালন হচ্ছে না। যদি পাহাড়ে বসতি স্থাপন করতে না দেয় তাহলে এ রকম বর্ষার সময় প্রাণহানির ঝুঁকি নিয়ে চিন্তাও করতে হবে না। এ জন্য শুধু বৃষ্টি হলে তোড়জোড় করলে হবে না। সারা বছর এ বিষয়ে প্রশাসনকে সজাগ থাকতে হবে।