গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিএনপির নেতা-কর্মীদের অনেকে ভোটের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হাসান উদ্দিন সরকারের ভাতিজা সরকার শাহনুর ইসলাম স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী হয়ে ইতিমধ্যে প্রচার শুরু করেছেন। দলটির অন্তত ২৪ জন নেতা-কর্মী কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন। স্থানীয় বিএনপি এবং ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে তথ্য সংগ্রহ করে এই ২৪ জনের কাউন্সিলর হওয়ার বিষয়ে প্রথম আলো নিশ্চিত হয়েছে।
যদিও কাউন্সিলর পদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হয় না। এরপরও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আসন্ন সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর পদেও দলগতভাবে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল। গাজীপুরে দলটির অনেকে যে প্রার্থী হচ্ছেন, এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি কী পদক্ষেপ নেবে—এ নিয়ে নানা আলোচনা চলছে।
২৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে সিটি করপোরেশনের ৫৭টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ৩০০ জন ও মেয়র পদে ১২ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। তবে যাচাই-বাছাই শেষে বর্তমানে মেয়র পদে আছেন ৯ জন প্রার্থী। আর কাউন্সিলর পদে আছেন ২৭৩ জন। এর মধ্যে মেয়র পদে ১ জন ও কাউন্সিলর পদে ২৪ জন বিএনপির নেতা-কর্মী প্রত্যক্ষভাবে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপির মহানগর, ওয়ার্ডসহ বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন।
গাজীপুর মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব শওকত হোসেন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার জানামতে বা যতটুকু চিনি, বিএনপির এমন ২৩ থেকে ২৪ জন কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করছেন। আর মেয়র পদে যিনি (শাহনুর) নির্বাচন করছেন, তাঁর দলীয় কোনো পদ-পদবি নেই। তবে তাঁর বাবা ও চাচা বিএনপির নেতা। আমাদের স্থায়ী কমিটি মিটিং (বৈঠক) করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচনে অংশ নেওয়া যাবে না, কাউকে সমর্থনও করা যাবে না। এক কথায় এই ভোট বর্জন করতে হবে।’
নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, পাড়া-মহল্লাগুলোতে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত প্রার্থীরা পোস্টার, ফেস্টুন, ব্যানার ও বিলবোর্ড সাঁটিয়েছেন। তাঁরা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে ভোটারদের কাছে দোয়া চাইছেন। অনেক প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা চালাচ্ছেন। এর মধ্যে গতকাল শুক্রবার টঙ্গীর চেরাগআলী এলাকায় একটি মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করেন মেয়র প্রার্থী শাহনুর ইসলাম। নামাজ শেষে তিনি মুসল্লিদের কাছে দোয়া চেয়েছেন।
শাহনুর ইসলাম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। তিনি বর্তমানে দলীয় কোনো পদে নেই। এর আগে তাঁকে বিএনপি অথবা এর সহযোগী কোনো সংগঠনের পদেও দেখা যায়নি। তবে তাঁর পরিবার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হাসান উদ্দিন সরকার হলেন শাহনুরের চাচা। শাহনুরের বাবা নুরুল ইসলাম সরকার কেন্দ্রীয় যুবদলের শিল্পবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে একটি হত্যা মামলায় তিনি কারাগারে আছেন।
শাহনুর ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যখন নির্বাচন করব সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তখন সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা আমাকে চায়। বর্তমান সরকারের ওপর আস্থা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। জাহাঙ্গীর আলম এবং আজমত উল্লা খান দুজনই নৌকার মানুষ। সে ক্ষেত্রে আমি চিন্তা করলাম, যেহেতু জাতীয়তাবাদী শক্তির একটি বড় অবস্থান গাজীপুরে আছে, তাই এই নির্বাচনী বৈতরণি পার হওয়ার জন্য আমার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সব দিক চিন্তা করে আমার নির্বাচনে আসা। আমার নির্বাচন করতে কোনো বাধানিষেধ আসেনি।’
এদিকে সিটি করপোরেশনের ৫৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৬ নম্বর ওয়ার্ডটি গাজীপুর শহরের কাছে। এই ওয়ার্ডে গত দুবারের নির্বাচিত কাউন্সিলর হলেন হান্নান মিয়া। তিনি সদর মেট্রো থানা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক। তিনি এবারও নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। ঈদের আগে থেকেই শুভেচ্ছা জানিয়ে আসছেন। এখন তিনি সক্রিয়ভাবে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রসঙ্গে হান্নান মিয়া বলেন, ‘কাউন্সিলর পদে নির্বাচনের ব্যাপারে দলীয় কোনো নির্দেশনা এখন পর্যন্ত পাইনি। কাউন্সিলররা যেহেতু দলীয় প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন না, তাই কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’
বিএনপির যাঁরা প্রার্থী হয়েছেন
নির্বাচনে বিএনপির নেতাদের অংশগ্রহণের বিষয়ে মহানগর বিএনপির ১২ জন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ১১ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপির নেতা আলমগীর হোসেন আলম, ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে শ্রমিক দল নেতা ফয়সাল আহমাদ সরকার, ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর ও বাসন থানা বিএনপির সদস্যসচিব মোসলেম উদ্দিন চৌধুরী, ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মো. রফিকুল ইসলাম, ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলর ও বিএনপি নেতা তানভীর আহমেদ, সদর মেট্রো থানার ২২ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপি নেতা ছবদের হাসান, ২৩ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপির সমর্থক খোরশেদ আলম, ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপি নেতা সাবেক কাউন্সিলর মাহবুবুর রশিদ খান, ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলর ও বিএনপির সমর্থক মজিবুর রহমান, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর ও সদর মেট্রো থানার সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. হান্নান মিয়া, ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর ও সদর থানা বিএনপির আহ্বায়ক হাসান আজমল ভুঁইয়া, ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি নেতা খায়রুল আলম ও সাবেক ছাত্রদল নেতা মনির হোসেন, ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপির সমর্থক শামসুল আলম অরুণ কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন।
এ ছাড়া গাছা থানা এলাকায় ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপির সমর্থক ও সাবেক কাউন্সিলর মো. মাহফুজুর রহমান, ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে গাছা থানা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফারুক হোসেন, পুবাইল থানা এলাকার ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের পুবাইল থানা বিএনপির সদস্যসচিব মো. নজরুল ইসলাম, ৪২ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপির নেতা সুলতান উদ্দিন আহমেদ, ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলর টঙ্গী পূর্ব থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিউদ্দিন আহমেদ, ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডে মেট্রো থানা বিএনপির সদস্য মিলন হোসেন, ৫৫ নম্বর ওয়ার্ডে শ্রমিক দল নেতা আবুল হোসেন ও সেলিম মিয়া প্রার্থী হয়েছেন।
গাজীপুর মহানগর বাসন থানা বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘গাজীপুর সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে দল থেকে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। কেউ নির্বাচন করলে সেটা তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়। কাউন্সিলর পদে কেউ নির্বাচন করলেও আমরা তাঁর সঙ্গে নেই।’