পাশাপাশি কবরে চিরশায়িত চার শিশু, গ্রামজুড়ে মাতম

কুষ্টিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত এক শিশুর পরিবারের স্বজনদের আহাজারিছবি: প্রথম আলো

তানজিলা আগে থেকেই পবিত্র কোরআন পড়তে শিখেছিল। গতকাল রোববার থেকে তার বড় বোন নুসরাত ইসলাম ওরফে মারিয়ারও পবিত্র কোরআন পড়া শুরু করার কথা ছিল। এমন আনন্দঘন মুহূর্ত উদ্‌যাপনে বাড়ি থেকে দুই কেজি বাতাসা নিয়ে পাশের মক্তবে পড়তে গিয়েছিল তারা। তবে কিছুক্ষণ পরই সেই আনন্দ বিষাদের রূপ নেয়। সেখান থেকে বাড়ি ফেরার পথে এই দুই বোন প্রাণ হারায়। সেই সঙ্গে একই দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে মিম ও যূথী নামের আরও দুই শিশু।

গতকাল সকাল সোয়া সাতটার দিকে কুষ্টিয়ায় খোকসা উপজেলার শিমুলিয়া কুঠিপাড়ায় কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী আঞ্চলিক মহাসড়কের এ দুর্ঘটনা ঘটে। বিকেলে শিমুলিয়া কুঠিপাড়া ঈদগাহ মাঠে জানাজার পর স্থানীয় গোরস্থানে পাশাপাশি চারটি কবরে এই শিশুদের দাফন করা হয়েছে। এ সময় এলাকার সব শ্রেণি–পেশার মানুষ সেখানে জড়ো হয়। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার খবরে শোকে বিহ্বল ছিল তাঁরা। এ দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ফাতেমা নামের আরেক শিক্ষার্থী কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। দুর্ঘটনায় হতাহত সবাই শিমুলিয়া কুঠিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ও প্রতিবেশী।

আরও পড়ুন

দুর্ঘটনার সময় মসজিদেই অবস্থান করছিলেন মক্তবটির একমাত্র শিক্ষক ও কুঠিপাড়া মসজিদের ইমাম আবদুল হক। হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পান তিনি। তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এসে দেখেন, রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে তাঁর পাঁচ ছাত্রী। তিনি বলেন, পড়ানো শেষ করে সকাল সাড়ে ৬টার দিকে মক্তবের ১৩ জন ছাত্রছাত্রীকে একসঙ্গে ছুটি দিয়েছিলেন। প্রতিদিনের মতো যে যার মতো বাড়ি ফিরছিল। আর হতাহত শিক্ষার্থীদের বাড়ি একই দিকে হওয়ায় তারা একসঙ্গে ফিরছিল। ওই সময়ই ঘটে দুর্ঘটনা।

কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, পড়া শেষে শিশুরা সড়কের ডান পাশ দিয়ে বাড়ি ফিরছিল। এ সময় কুষ্টিয়াগামী ওই চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে শিশুদের ওপর মাইক্রোবাস তুলে দেন। এতে চাপা পড়ে পাঁচ শিশু। তাদের মধ্যে ঘটনাস্থলেই একজনের মৃত্যু হয়। আর হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যায় আরও তিনজন।

কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, পড়া শেষে শিশুরা সড়কের ডান পাশ দিয়ে বাড়ি ফিরছিল। এ সময় কুষ্টিয়াগামী ওই চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে শিশুদের ওপর মাইক্রোবাস তুলে দেন। এতে চাপা পড়ে পাঁচ শিশু। তাদের মধ্যে ঘটনাস্থলেই একজনের মৃত্যু হয়। আর হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যায় আরও তিনজন।

সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের জন্য বাড়ির পাশের মক্তবে তানজিলা ও মারিয়াকে পড়তে পাঠিয়েছিলেন পালন মিয়া ও নাজমা খাতুন দম্পতি। এই কৃষক দম্পতির স্বপ্ন ছিল মেয়েরা লেখাপড়া শিখে বড় মানুষ হবে। তবে সেই স্বপ্ন মুহূর্তেই তছনছ হয়ে গেল! তাঁদের তিন সন্তানের মধ্যে মারিয়া ও তানজিলা ছাড়া আশরাফ নামের ছোট এক ছেলে আছে। অন্যদিকে দুর্ঘটনায় নিহত মিম সম্পর্কে তানজিলা ও মারিয়ার চাচাতো বোন।

শিমুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল তানজিলা ও মারিয়া। আর মিম ও যূথী পড়ত গ্রামের পূর্বাশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। শিমুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আশরাফুজ্জামান জানান, ছাত্রী হিসেবে নিহত দুই বোন (তানজিলা ও মারিয়া) বেশ ভালো ছিল। পড়ার প্রতি বেশ আগ্রহী ছিল। বাবা অসচ্ছল হলেও মেয়েদের লেখাপড়ার ব্যাপারে তাঁর চেষ্টা ছিল।

বিকেলে ছাত্রীদের লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স গ্রামের আসার পরপর স্বজন ও গ্রামবাসীর আহাজারিতে চারপাশ ভারী হয়ে ওঠে। ওই ছাত্রীদের স্কুলের শিক্ষক, সহপাঠী, প্রতিবেশীরাও শোকে ভেঙে পড়েন। একই দুর্ঘটনায় দুই মেয়েকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন নাজমা খাতুন। প্রতিবেশী ও স্বজনেরা তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তিনি যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না। কিছুক্ষণ পর একনাগাড়ে বিলাপ করছিলেন। পাশেই বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন দাদি। একটু দূরেই ওই দুই শিশুর বাবাকে নিশ্চুপ বসে থাকতে দেখা গেল।

কয়েক দফা চেষ্টার পরও কথা বলতে পারছিলেন না পালন। গলা ধরে আসছিল। খানিক বাদে ক্ষীণকণ্ঠে বলেন, ‘কার কাছে আর অভিযোগ দেব? আমার যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমার আর কী করার আছে। আশা ছিল মেয়েদের মানুষের মতো মানুষ করার।’

কার কাছে আর অভিযোগ দেব? আমার যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমার আর কী করার আছে। আশা ছিল মেয়েদের মানুষের মতো মানুষ করার।
তানজিলা ও মারিয়ার বাবা পালন মিয়া

এদিকে এ দুর্ঘটনার পরপরই চালক পালিয়ে যান। আজ সোমবার সকাল পর্যন্ত তাঁকে গ্রেপ্তার বা আটক করা যায়নি। এ বিষয়ে কুষ্টিয়া চৌড়হাস হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আকুল চন্দ্র বিশ্বাস প্রথম আলোকে জানান, এ ঘটনায় এখনো মামলা হয়নি। পরিবার যদি মামলা না করে, তাহলে বাদী হয়ে মামলা করবে পুলিশ। চালককে আটক করতে অভিযান চলছে।