দাদনের ফাঁদে ইলিশ

ইলিশ মাছফাইল ছবি: প্রথম আলো

বরেণ্য লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর বিভিন্ন লেখায় ঘুরেফিরে এসেছে বাংলার ইলিশের অতুলনীয় স্বাদ। ‘আড্ডা’ নামের এক প্রবন্ধে তিনি বেহেশতি খাবারের প্রসঙ্গ তুলে ইলিশকে ‘অমৃত’র আসনে বসিয়েছেন। একবার এক পাঞ্জাবি অধ্যাপকের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী জোরগলায় বলেন, ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবার হলো সরু চালের ভাত আর ইলিশ’; কিন্তু পাঞ্জাবি সেটা মানতে নারাজ। তাঁর মতে, বিরিয়ানিই শ্রেষ্ঠ। এ নিয়ে মুজতবা আলী এমন খেপলেন যে ওই অধ্যাপকের সঙ্গে সপ্তাহখানেক আর কথাই বললেন না।

আজ যদি মুজতবা আলী বেঁচে থাকতেন, ইলিশের মহিমা প্রচারের আগে হয়তো এর দাম নিয়ে দশবার ভাবতেন। ভরা মৌসুমেই এখন ইলিশের বাজারে আগুন। সাধারণ মানুষের নাগাল শুধু না, ভাবনারও বাইরে চলে গেছে ইলিশ। কীভাবে হলো এ অবস্থা? এই তো ২০২০-২১ সালে করোনা মহামারির সময় ঢাকার ফুটপাতে পদ্মা-মেঘনার ইলিশ বিক্রি হতে দেখা গেছে। দামও ছিল তুলনামূলক সস্তা; কিন্তু এখন কেন ইলিশের হাহাকার? দামে আগুন? এটা কি শুধুই ভারতে রপ্তানির অজুহাতে? নাকি আগে থেকেই ঘটে আসা অন্য কোনো ঘটনা?

আরও পড়ুন

প্রশ্নগুলো মাথায় নিয়ে ইলিশের অতি মূল্যের বিষয়টা তলিয়ে দেখতে অনুসন্ধানে নামে প্রথম আলো। একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইলিশের প্রজনন ও উৎপাদন; অন্যদিকে বহুদিন ধরে চলে আসছে নদী দখল-দূষণ আর ইলিশ কারবারিদের অপতৎপরতা। নিষিদ্ধ মৌসুমে ডিমওয়ালা মা ইলিশ ধরা ও নিষিদ্ধ জালে পোনা-জাটকা শিকার চলে সারা বছর। সব মিলিয়ে ইলিশের দেশে এখন লেগেছে আকাল। জেলেদের জালে মিলছে না ইলিশ। যাও–বা মেলে, তা নিয়ে শুরু হয় অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কাড়াকাড়ি আর কারসাজি। দাদন চক্র জিম্মি করে রেখেছে বাঙালির সাধের ইলিশকে।

এই তো ২০২০-২১ সালে করোনা মহামারির সময় ঢাকার ফুটপাতে পদ্মা-মেঘনার ইলিশ বিক্রি হতে দেখা গেছে। দামও ছিল তুলনামূলক সস্তা; কিন্তু এখন কেন ইলিশের হাহাকার? দামে আগুন? এটা কি শুধুই ভারতে রপ্তানির অজুহাতে? নাকি আগে থেকেই ঘটে আসা অন্য কোনো ঘটনা?
ইলিশ কেনাবেচা চলছে
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে এই দাদন চক্রের অন্তত পাঁচটি ফাঁদের সন্ধান মিলেছে, যেখানে ওত পেতে থাকেন পাঁচ ধরনের কারবারি। তাঁরা প্রত্যেকে একই সঙ্গে ইলিশের ক্রেতা ও বিক্রেতা; এবং তাঁদের মধ্যে মাঝখানের তিনজন আবার দাদনের (ঋণের আঞ্চলিক নাম) জালে বাঁধা। যে যাঁকে দাদন দিয়েছেন, তিনি শুধু তাঁর হাতেই ইলিশ তুলে দিতে বাধ্য; বাজার যাচাইয়ের কোনো সুযোগ নেই কারও। এই অদ্ভুত বাজারব্যবস্থার মধে৵ পড়েই দফায় দফায় দাম চড়ে ইলিশের।

অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে আমরা দেখতে পাই, একদল জেলে জীবন বাজি রেখে ৯-১০ দিন সাগরে ভেসে যে মাছ ধরে আনলেন, তা বিক্রি হলো ছয় লাখ টাকায়। পরে দাদন চক্রের মারপ্যাঁচে দেখা গেল, ওই পাঁচ ধাপের কারবারি প্রত্যেকেই কমবেশি অতি মুনাফা করলেন; অথচ মাছশিকারি জেলেরা মাথাপিছু ৫৭১.৪২ টাকার দেনা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন।

আরও পড়ুন

অনুসন্ধানে আরও একটি দিক উঠে এসেছে। তা হচ্ছে, আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশের বাজার ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সুস্পষ্ট আইনি নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও তা মানা হয় না। ফলে বাঙালির জীবনের গোটা ইলিশ পর্বটাই জিম্মি হয়ে পড়েছে ওই দাদন চক্রের কাছে। আমরা দেখেছি, দামের নাটাই ধরে আছেন ইলিশ কারবারের সব থেকে বড় পুঁজিপতিরা, যাঁদের বলা হয় ‘বড় আড়তদার’। এঁদের অবস্থান রাজধানীসহ অন্যান্য মহানগরে।

প্রশ্নগুলো মাথায় নিয়ে ইলিশের অতি মূল্যের বিষয়টা তলিয়ে দেখতে অনুসন্ধানে নামে প্রথম আলো। একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইলিশের প্রজনন ও উৎপাদন; অন্যদিকে বহুদিন ধরে চলে আসছে নদী দখল-দূষণ আর ইলিশ কারবারিদের অপতৎপরতা।

প্রথম আলোর এই অনুসন্ধানে দেশের ইলিশ–অধ্যুষিত এলাকাগুলোর চারজন প্রতিনিধি ও প্রতিবেদক কাজ করেছেন। তাঁরা নদ-নদী-সাগর-মোহনা; ইলিশের অভয়াশ্রম, ইলিশঘাট, বাণিজ্যকেন্দ্র এবং খুচরা বাজারগুলোতে ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করেন তথ্য-প্রমাণ। সেগুলো নিয়ে করা হয় বিশ্লেষণ-গবেষণা। তা তুলে ধরা হয় বিশেষজ্ঞদের কাছে। পরামর্শ নেওয়া হয় আইনজ্ঞদের। তাঁদের বক্তব্য-মন্তব্যের সূত্র ধরে খোঁজা হয় ইলিশ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর তৎপরতা।

অনুসন্ধানকালে আমাদের এক প্রতিনিধিকে স্থানীয় আড়তদারদের একজন ঠোঁট বাঁকিয়ে শুনিয়ে দিয়েছেন, ‘দ্যাশের মানুষ, গরিব মানুষ! হ্যারা ইলিশের দিকে তাকায় ক্যা? হ্যাগর লাগি তো এই মাছ না! এই মাছ খাইবে বড়লোকেরা…।’

আরও পড়ুন

কথাটা তুললে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিহাব উদ্দিন খান প্রথম আলোকে বললেন, কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়ে-কমিয়ে যদি ইলিশের বাজার অস্থির করা হয় এবং সে কারণে দেশের নাগরিকেরা যদি ইলিশ খেতে না পারেন, তাহলে সেটি আইনগতভাবে নাগরিকের অধিকার খর্ব করার শামিল।

দ্যাশের মানুষ, গরিব মানুষ! হ্যারা ইলিশের দিকে তাকায় ক্যা? হ্যাগর লাগি তো এই মাছ না! এই মাছ খাইবে বড়লোকেরা…
স্থানীয় আড়তদার

ইলিশ বেচে জেলেরা ফেরেন দেনা নিয়ে

ইলিশ মাছ
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

গত ২৫ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে সাতটায় ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির মধ্যে বরগুনার পাথরঘাটা বিএফডিসি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে পৌঁছান আমাদের পাথরঘাটা প্রতিনিধি আমিন সোহেল। আসুন, তাঁর চোখ দিয়ে দেখি সেখানকার ঘটনাপ্রবাহ:

ইজিবাইক থেকে নামতেই মানুষের কোলাহল। একটু এগোলেই পাইকারি মাছের বাজারের দোতলা ভবন। এটি ঘিরেই বেচাকেনা, প্যাকেজিং ও পরিবহন ব্যবস্থাপনা চলে দিনব্যাপী। বিএফডিসির এই মূল ভবনের পেছনের ঘাটে সারি সারি মাছের ট্রলার নোঙর করা। কয়েকটি ট্রলার থেকে মাছ খালাসের কাজ চলছে। একটির মাছ নামানো শেষ হতেই নিরাপত্তারক্ষীর বাঁশিতে ফুঁ। এবার এফবি মরিয়ম নামের ট্রলারটি জেটির দিকে এগোতে থাকে। শক্ত হাতে সুকানি ধরে একজন ট্রলারটি ঘাটে ভেড়ালেন। ট্রলারের খোন্দল থেকে ঝিলিক দিয়ে উঠল রুপালি ইলিশ।

আরও পড়ুন

সুকানি ধরা সেই মাঝবয়সি হলা মাঝি (সহকারী মাঝি) এমাদুল হকের কাছে জানা গেল, সাত দিন আগে তাঁরা সাগরে গিয়ে গত সন্ধ্যায় এই ঘাটে ফিরে নোঙর করেছেন। মূল মাঝিসহ অর্ধেক সদস্য চলে গেছেন বাড়িতে। অর্ধেক আছেন, মাছ বিক্রি হলে যাবেন। এই ট্রলারের মালিকের নাম জসীম উদ্দিন। তিনি ট্রলার বুঝিয়ে দেন মূল মাঝিকে। মাঝিই ঠিক করেন দলবল। যেমন ইউনুস মাঝি তাঁর সহকারী বা হলা মাঝি ১ জন, বাবুর্চি ১ জন, মিস্ত্রি ১ জন এবং জেলে ১৩ জন, নিজেসহ মোট ১৭ জনের দল গঠন করে উঠেছেন এফবি মরিয়ম ট্রলারে। পদবি ভিন্ন হলেও তাঁরা সবাই আসলে জেলে; সবাই অংশ নেন মাছ শিকারে।

কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়ে-কমিয়ে যদি ইলিশের বাজার অস্থির করা হয় এবং সে কারণে দেশের নাগরিকেরা যদি ইলিশ খেতে না পারেন, তাহলে সেটি আইনগতভাবে নাগরিকের অধিকার খর্ব করার শামিল।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিহাব উদ্দিন খান

খোন্দল থেকে জেলেরা ইলিশ তুলছেন আর ঘাটশ্রমিকেরা হাতে গ্লাভস ও সাজি নিয়ে লাইন দিয়ে ট্রলারের সামনে দাঁড়িয়েছেন। মাথায় মাথায় ঝাঁপি বদল করে ইলিশ নিয়ে তাঁরা মেসার্স মা ফিশ নামের আড়তের চটে (মেঝেতে) ফেলছেন। এই আড়তের মালিকের নাম আবদুস সালাম।

চটে মাছ তোলা শেষ হতেই শুরু হলো নিলামের পালা। ঘিরে আছেন পাইকারেরা। আড়তদার সালাম হাঁক তুললেন, ‘দাম কন, দাম কন...।’ আব্বাস হোসেন, বাচ্চু গাজী ও জাকির মুন্সি নামের তিন পাইকার আঙুল দিয়ে টিপে টিপে ইলিশের অবস্থা পরখ করছেন দেখে আড়তদার বলে উঠলেন, ‘খারাপ না। দ্যাহন লাগবে না; একের (১ নম্বর) মাছ’ বলেই আবার হাঁক, ‘দাম কন, দাম কন।’

প্রথমেই ৫১ হাজার টাকা মণ দাম করলেন পাইকার জাকির মুন্সি। আড়তদার দুবার ৫১, ৫১ হাজার বলতেই আরেক পাইকার বললেন, ৫২ হাজার। আরেক পাইকার ৫৩; আরেকজন ৫৩ হাজার ৫০০। এভাবে বাড়তে বাড়তে এক পাইকার বলে বসলেন, ৫৬ হাজার। এবার সব যেন ঠান্ডা। আড়তদার আবদুস সালাম ‘৫৬...৫৬’ বললেও কেউ আর দাম বলছেন না। পরে ৫৬-১, ৫৬-২, ৫৬-৩ বলেই আবদুস সালাম শেষ করলেন নিলাম ডাকা। অবশেষে ৫৬ হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি হয়ে গেল এফবি মরিয়ম ট্রলারের সব ইলিশ।

যে পাইকার কিনলেন, জানা গেল তাঁর নাম বাচ্চু গাজী। তিনি পাথরঘাটারই বাসিন্দা। মরিয়ম ট্রলারের ৫ মণ ইলিশ ২ লাখ ৮০ হাজার টাকায় কিনে নিলেন পাইকার বাচ্চু গাজী। এ ছাড়া তিনি ওই ট্রলারের বিভিন্ন প্রজাতির আরও ১ লাখ ২০ হাজার টাকার মাছ নিলামে কিনলেন।

প্রথমেই ৫১ হাজার টাকা মণ দাম করলেন পাইকার জাকির মুন্সি। আড়তদার দুবার ৫১, ৫১ হাজার বলতেই আরেক পাইকার বললেন, ৫২ হাজার। আরেক পাইকার ৫৩; আরেকজন ৫৩ হাজার ৫০০। এভাবে বাড়তে বাড়তে এক পাইকার বলে বসলেন, ৫৬ হাজার। এবার সব যেন ঠান্ডা।

এবার ওই পাঁচ মণ ইলিশ যাচ্ছে বাচ্চু গাজীর ঘরের চটে। আমরাও পিছু নিলাম। ইলিশগুলো চটে ফেলে আকার, সতেজতা ও উজ্জ্বলতা ভেদে আলাদা করা হলো। বেশির ভাগেরই ওজন ৮৫০ গ্রাম। এবার কর্কশিটের বাক্সে ২৫টি করে ইলিশ তোলা হলো। একেকটা বাক্সের ওজন হলো ২১ কেজি করে। পরে বাক্সগুলোতে বরফ ঢুকিয়ে স্কচটেপ পেঁচিয়ে প্যাকেজিং সম্পন্ন হলো।

বাচ্চু গাজীর চটে একইভাবে ৮৫০ গ্রামের আরও ৩৫ মণ ইলিশ কর্কশিটের বাক্সে ভরে খুলনা মেট্রো ড–১১-০৩৩৬ নম্বর ট্রাকে তুলে দেওয়া হলো। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে ট্রাকটি রওনা হলো খুলনার উদ্দেশে। ট্রাকচালক আল মামুন বললেন, এই মাছ খুলনার গোলচত্বর বা রূপসা ঘাটে নামাতে বলেছেন পাইকার। তবে জায়গা বদলাতেও পারে। তাঁরা যেখানে বলবেন, সেখানেই নামানো হবে।

ট্রাক রওনা করলে আমরা ফিরলাম ‘মা ফিশ’-এর মালিক আবদুস সালামের আড়তে। কথায় কথায় তিনি জানান, মরিয়ম ট্রলারের পাঁচ মণ ইলিশের ২ লাখ ৮০ হাজার ও অন্য মাছের ১ লাখ ২০ হাজার টাকা—এই মোট চার লাখ টাকার মাছ বিক্রি থেকে তিনি শতকরা আট টাকা কমিশন ধরে ৩২ হাজার টাকা পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘তবে ওই এফবি মরিয়ম ট্রলারে আমার ১০ লাখ টাকার দাদন দেওয়া আছে। সে কারণেই ৮ পারসেন্ট আড়তদারি কেটে রাখি। এভাবে সাতটা ট্রলারে ৭০ লাখ টাকা দাদন দিয়ে মাছ ব্যবসা চালাচ্ছি।’

আপনাদের দাদন ব্যবসার কোনো অনুমোদন আছে কি? জবাবে আবদুস সালাম প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘অ জিগাইয়া হরবেন কী? পরে একসময় কমু আনে।’ আছে কি নেই প্রশ্ন করলে তিনি কোনো জবাব না দিয়ে হেঁটে যেতে থাকেন। তাঁর পিছু নিলে তিনি বলেন, ‘এহন কিছু কমু না। পরে চা-নাশতা খাইতে আইয়েন, নিরিবিলি কমু আনে।’

বোঝা গেল, দাদন চক্রের দ্বিতীয় ফাঁদে সালামের মতো আড়তদারেরা বসে আছেন। প্রথম ফাঁদে থাকেন ট্রলারমালিক নিজে। একেকটা ট্রলার তৈরি ও সাজানোর পেছনে খরচ হয় ৫০ লাখ থেকে ৯০ লাখ টাকার মতো। আরও বেশি দামের ট্রলারও আছে বিভিন্ন এলাকায়। এই ট্রলারের মালিকেরা দাদন যেমন নেন, তেমনি নিজেরাও আবার দাদন দিয়ে ‘কিনে’ নেন মাঝি ও তাঁর জেলে দলকে।

দাদন ছাড়াও ইলিশ ধরা একেকটা ট্রলার সাগরে যেতে হলে কয়েক লাখ টাকার বাজারসদাই লাগে। ডিজেল, বরফ, গ্যাস সিলিন্ডার থেকে শুরু করে সাত দিনের চাল-ডাল-তেল-লবণ, মসলাপাতি, সবজি, পান-সিগারেট-চা, খাওয়ার পানির ড্রাম পর্যন্ত। এসব কিনে দেন ট্রলারের মালিক। তবে নদীতে ইলিশ শিকারে এত কিছু লাগে না। সেখানকার পরিস্থিতি ভিন্ন। তা ছাড়া ইদানীং নদীতে ইলিশ নেই বললেই চলে।

এফবি মরিয়ম ট্রলারের হলা মাঝি এমাদুল হকের কাছে জানা যায়, তাঁদের ট্রিপের জন্য সাড়ে চার লাখ টাকার বাজার করে দেন ট্রলারের মালিক জসীম উদ্দিন। ১৫ সেপ্টেম্বর তাঁরা রওনা করেন সাগরে; কিন্তু আবহাওয়া খারাপ থাকায় দুই দিন পরেই ফিরে আসতে হয়। ওই ছোট ট্রিপে দুই লাখ টাকার মাছ পান। এবার পেলেন চার লাখ টাকার। দুই ট্রিপে ছয় লাখ টাকা। এ থেকে বাজারসদাইয়ের সাড়ে চার লাখ বাদ দিলে থাকে দেড় লাখ টাকা।

অ জিগাইয়া হরবেন কী? পরে একসময় কমু আনে।’ আছে কি নেই প্রশ্ন করলে তিনি কোনো জবাব না দিয়ে হেঁটে যেতে থাকেন। তাঁর পিছু নিলে তিনি বলেন, ‘এহন কিছু কমু না। পরে চা-নাশতা খাইতে আইয়েন, নিরিবিলি কমু আনে
আবদুস সালাম

এবার দেখুন দাদনের শাঁখের করাতে কাটাকুটির খেলা। মাঝি ইউনুসকে ট্রলারমালিক জসীম দাদন দিয়ে রেখেছেন চার লাখ টাকা। এই দাদনের কমিশনের হার ৯ শতাংশ। ট্রলারমালিককে আবার আড়তদার আবদুস সালাম দাদন দিয়েছেন ১০ লাখ টাকা। এই দাদনের কমিশন ৮ শতাংশ। এখন জেলে-মাঝিরা দুই ট্রিপে যে মাছ ধরে এনেছেন, তার দাম ছয় লাখ টাকা। এই ছয় লাখ থেকে দাদনের কমিশন ৯+৮=১৭ শতাংশ কেটে রাখা হলো ওই দেড় লাখ টাকা থেকে। এই কর্তনের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ২ হাজার টাকা। তাহলে কেটেকুটে জেলে-মাঝিদের পাওনা থাকল ৪৮ হাজার টাকা।

আরও কথা আছে। মূল মাঝি ইউনুস দায়িত্ব নিয়ে দাদনের চার লাখ টাকা অভিজ্ঞতা অনুযায়ী বণ্টন করে নিয়েছেন দলের ১৭ জনের মধ্যে। আবার এত দামি ট্রলারের দায়িত্ব নিয়ে দলের নেতৃত্বও দিয়েছেন তিনি। তাই তাঁর পাওনাটা একটু বেশি—মাছ বিক্রির টাকার প্রতি লাখে এক হাজার করে; ছয় লাখে ছয় হাজার টাকা। সেটা বাদ দিলে থাকল ৪২ হাজার। এখান থেকে বাদ যাবে দলের ১৭ জনের হাতখরচ বাবদ দুই হাজার। থাকে ৪০ হাজার টাকা।

তাহলে যে জেলে-মাঝিরা পরিবার-পরিজন ফেলে জীবন বাজি রেখে ৯-১০ দিন সাগরে দিন–রাত একাকার করে ছয় লাখ টাকা দামের মাছ ধরে আনলেন, তাঁদের ভাগে শেষমেশ কত টাকা করে পড়ল? ১৫ হাজার টাকা ২১ ভাগ করলে প্রতি ভাগে পড়ে মাত্র ৭১৪ টাকা ২৯ পয়সা।

ভাগবাঁটোয়ারার এই নিয়ম মানতে বাধ্য জেলে-মাঝি সবাই। কারণ, ওই দাদন চক্র। মুখে মুখে হওয়া চুক্তির এসব শর্ত মানতে বাধ্য ওরা।

কাহিনির এখানেই শেষ নয়। ‘পাছে লোকে কিছু বলে’—যেন এই ভয়েই দাদনদার ট্রলারমালিক ওই ১৫ হাজারের সঙ্গে নিজেদের পকেট থেকে আরও ২৭ হাজার টাকা যোগ করে ৪২ হাজার বানিয়ে ২১ ভাগ করে প্রতি ভাগে ২ হাজার টাকা করে পাওয়ার দয়া দেখিয়ে জেলেদের বিদায় করেন। এই দয়ার আড়ালেও লুকিয়ে থাকে আরেক প্রহসন। বলে দেওয়া হয়, এই ২৭ হাজার টাকা ধার বা কর্জ হিসেবে দেওয়া হলো। পরের ট্রিপগুলোয় মাছ না পেলে কোনো দাবি নেই; তবে মাছ পেলে সেই মাছের দাম থেকে কর্জ সমন্বয় করা হবে।

৩০ বছর ধইরা গাঙ্গে মাছ ধরি। কিছুই লাভ অয় না। আমরা জাইল্লারা হোমান হোমান (সমান সমান)। লাভ সব হ্যাগর।
এফবি মরিয়ম ট্রলারের হলা মাঝি এমাদুল হক

নিরুপায় জেলেরা সেটাই মেনে নেন। তাতে করে হিসাব দাঁড়ায়, প্রত্যেকের ভাগে পড়ল ৭১৪ টাকা ২৯ পয়সার আয় আর ১ হাজার ২৮৫ টাকা ৭১ পয়সার দেনা। এভাবে এফবি মরিয়ম ট্রলারের ১৭ জন জেলে-মাঝি ৯-১০ দিনের জীবন-মরণ পরিশ্রমের বিনিময়ে একেকজনের ভাগ অনুযায়ী ৫৭১ টাকা ৪২ পয়সার দেনা ঘাড়ে নিয়ে বাড়ি ফিরে যান।

যাওয়ার আগে এফবি মরিয়ম ট্রলারের হলা মাঝি এমাদুল হক একটা দুঃখের হাসি দিয়ে বললেন, ‘৩০ বছর ধইরা গাঙ্গে মাছ ধরি। কিছুই লাভ অয় না। আমরা জাইল্লারা হোমান হোমান (সমান সমান)। লাভ সব হ্যাগর।’

দুই দিন পর খোঁজ নিতে এমাদুলের বাড়ি গেলে আলাপচারিতার সময় তাঁর ৩০ বছর বয়সী মেয়ে শিরীন আক্তার বললেন, ‘মা হালিমা বেগম দুই বছর ধরে আর দাদি রাবেয়া খাতুন তিন বছর ধরে অসুস্থ। দুজনের পিছে প্রতিদিন ৮০-১০০ টাকার ওষুধ লাগে। ছোট ভাই ইয়াসিন আরাফাতের কলেজে যাওয়া-আসায় লাগে ১০০ টাকা করে। ওর একটা চাকরি ছাড়া বাবার পক্ষে আর সংসার চালানো সম্ভব না।’

কানে বাজে আড়তদার আবদুস সালামের কণ্ঠ। নিলামের শুরুতেই দাম বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা থাকে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘মোরা তো চাই ইলিশের দামডা যাতে বেশি ওডে। তাইলে জইলারা দুইডা ট্যাহা বেশি পাইবে।’

বানরের রুটি ভাগের গল্পটা বাস্তবে দেখার পর আড়তদারের শেষ বাক্যটা তামাশা মনে হয় না? তবে ইলিশের দাম যাতে প্রথম দফাতেই বেশি ওঠে, সেই চেষ্টা কারবারিদের সবাই করবেন, এটাই স্বাভাবিক। কারণ, সবারই পিছে লেগে থাকে দাদনের জ্বালা।

{এই প্রতিবেদন তৈরিতে অংশ নিয়েছেন আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ, রাজশাহী; এম জসীম উদ্দীন, বরিশাল; শেখ আল–এহসান, খুলনা ও আমিন সোহেল, পাথরঘাটা, বরগুনা}

আগামী পর্ব: দাদনের জাল ঢাকা থেকে সাগরে।