সন্ধ্যার নির্জন দ্বীপেও নবী হোছেনকে অপেক্ষায় রাখে অভাব
সেন্ট মার্টিনের দক্ষিণের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ছেঁড়াদিয়ায় ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গেছে। বেশ ঠান্ডা বাতাস বইছে। তখনো দ্বীপের পূর্ব অংশের পাথরস্তূপে দাঁড়িয়েছিলেন নবী হোছেন (৭৫)। গায়ে পুরোনো কোট, মাথায় গরম টুপি, গলায় মাফলার, পরনে লুঙ্গি। আশপাশে কেউ নেই।
নির্জন এ দ্বীপে সন্ধ্যাবেলা কার জন্য অপেক্ষা করছেন, জানতে চাইলে নবী হোছেনের জবাব, ‘পর্যটকের জন্য। সন্ধ্যারাতে কিছু পর্যটক ছেঁড়াদিয়া ঘুরতে আসেন। তাঁদের অপেক্ষায় আছি। তাঁরা এলে চা, বিস্কুট, পান, সিগারেট বিক্রি হবে। ঘরে অভাব, টাকা ছাড়া ঘরে যেতে মন চাইছে না।’
প্রতিবেশ সংকটাপন্ন ছেঁড়াদিয়াতে পর্যটকের যাতায়াত নিষিদ্ধ। এরপরও প্রতিদিন সেন্ট মার্টিন দ্বীপ থেকে দুই হাজারের বেশি পর্যটক যাতায়াত করেন সেখানে। পর্যটকদের কেউ কেউ সেন্ট মার্টিন জেটি থেকে স্পিডবোট, গামবোট দিয়ে ছেঁড়াদিয়ায় ভ্রমণে যান। আবার কেউ কেউ যান সৈকতের বালুচর দিয়েও ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক-টমটম, মোটরসাইকেলে ও বাইসাইকেলে করে।
ছেঁড়াদিয়ায় পর্যটকের বেচাবিক্রির জন্য বসে ভ্রাম্যমাণ ১০-১৫টি দোকান। সকাল থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত পর্যটকে সরগরম থাকে দ্বীপ। তখন দোকানপাটে বেচাবিক্রি চলে বেশ। বিকেলে অধিকাংশ পর্যটক সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ফিরে গেলে দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সন্ধ্যা বা তার পরও দ্বীপের একটা স্থানে টেবিল রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যান নবী হোছেন। অপেক্ষা করেন পর্যটকের।
সন্ধ্যা ছয়টা। কিছুক্ষণ আগেই সূর্য ডুবে গেলেও ঘন অন্ধকার নামেনি। দূর থেকে মানুষজনের চলাফেরা পরখ করা যাচ্ছিল। ছেঁড়াদিয়ায় তখনো ছোট্ট একটি টেবিলে ছোলাভাজা, মুড়ি, চা-বিস্কুট ও পান-সিগারেট নিয়ে বসে আছেন প্রবীণ নবী হোছেন।
প্রথম আলোকে বলেন, সন্ধ্যারাতে অনেক পর্যটক টমটম ও মোটরসাইকেল নিয়ে ছেঁড়াদিয়ায় আসেন। তাঁদের অপেক্ষা করছেন। বেচাবিক্রি না হলে না খেয়ে থাকতে হয়। ঘরে বৃদ্ধ স্ত্রী, এক মেয়ে ও দুই ছেলে। বড় ছেলে জেলে শ্রমিক। সাগরে মাছ ধরা পড়ছে না মাসখানেক ধরে। তাই সে ছেলে বেকার বসে আছেন।
নবী হোছেনের বাড়ি সেন্ট মার্টিনের দক্ষিণপাড়ায়। ছোট ছেলে ওসমান গণী এবার এসএসসি পাস করলেও টাকার অভাবে কলেজে ভর্তি হতে পারেনি। সংসারে থাকা অভাবে কিছুটা হলেও প্রলেপ দেওয়ার মরিয়া চেষ্টায় এক মাস আগে এ দোকান দেন নবী হোছেন। বলেন, আজ বেচাবিক্রি হয়েছে ৫৫০ টাকার। সব খরচ শেষে লাভ ১১০ টাকা। এই টাকায় এক কেজি চাল ও এক কেজি আলু কিনে বাড়িতে যাবেন। বাড়িতে বসে থাকলে চাল–আলুও কেনা হতো না।
বছরে বয়স্ক ভাতা হিসেবে ৫ হাজার টাকা পান জানিয়ে নবী হোছেন বলেন, তরুণ বয়সে জেলে শ্রমিক ছিলেন। জাল ফেললেই তখন প্রচুর মাছ ধরা পড়ত। সেন্ট মার্টিনের মাছ সরবরাহ হতো টেকনাফ, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম। এখন সেন্ট মার্টিনে মাছ নেই। পর্যটকের চাহিদা পূরণে মাছ কিনে আনতে হচ্ছে টেকনাফ, কক্সবাজার থেকে। এক মাস ধরে তাঁর পরিবারে মাছ কেনা হয়নি।
২৫-৩০ বছর আগে দ্বীপের ঘরবাড়ি, নৌকা, ভ্যানগাড়ি তৈরির মিস্ত্রির কাজ করতেন এই প্রবীণ। এখন বয়স হয়েছে বলে কেউ কাজে ডাকেন না। নবী হোছেন বলেন, সকালে সাতটার দিকে দোকান খোলেন। কখনো কখনো রাত ১০টা অবধি দোকান খোলা রাখেন। দোকানে তাঁর পুঁজি ৭০০ টাকা। বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার পর্যটক বেশি আসেন, তখন বেচাবিক্রি এক-দুই হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়। এতে লাভ থাকে সর্বোচ্চ আড়াই শ টাকা।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপ আগের মতো নেই বলে আক্ষেপ করেন প্রবীণ এই ব্যক্তি। বলেন, আগে সৈকতজুড়ে শামুক, ঝিনুক, প্রবাল, শৈবালে ভরপুর ছিল। বালিয়াড়ি ছিল অনেক উঁচুতে। একটা সময় পর্যটকেরা ছেঁড়াদিয়া থেকে পলিথিন ভরে প্রবাল, শামুক, ঝিনুক নিয়ে যেত। ছেঁড়াদিয়ায় সমুদ্রের নীল পানিতে মিলত নানা প্রজাতির রঙিন মাছ। এখন এসব কিছুই নেই।
দ্বীপের চারদিকে স্থায়ী বেড়িবাঁধ দেওয়া দরকার বলে মনে করেন নবী হোছেন। বলেন, দ্বীপে চাষাবাদের জমি কমছে। হোটেল, রিসোর্ট, কটেজ, রেস্তোরাঁ বেড়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে পুরো দ্বীপ সাগরের পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। এ রকম জলোচ্ছ্বাস গত ৭০-৮০ বছরে দেখা যায়নি।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে নামে রাত। দূর অন্ধকার সমুদ্রে যেখানে ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে, সেখানে একমনে তাকিয়ে আছেন নবী হোছেন। পর্যটকেরা আসছেন, যাচ্ছেন। নবী হোসেন যেনবা ভাবছেন, একটা জীবন সমুদ্রের মতোই। তবু একদিন তো ফুরিয়ে যাবেই। পর্যটকদের জন্য তাঁর অপেক্ষাও ফুরাবে সেদিন।