সুনামগঞ্জে পানিতে ভেসেছে ৮ হাজার পুকুরের মাছ, ঋণ নিয়ে দুশ্চিন্তায় মৎস্যচাষিরা

সুনামগঞ্জে বন্যায় কয়েক হাজার পুকুরের প্রায় ৪ হাজার মেট্রিক টন মাছ ও পোনা ভেসে গেছে। সম্প্রতি সদর উপজেলার বুড়িস্থল এলাকা থেকে তোলাছবি: খলিল রহমান

এনামুল হকের মাছের সাতটি বড় পুকুর আছে। এসব পুকুরে প্রায় ২০ লাখ টাকার মাছ চাষ করেছিলেন তিনি। যখন মাছ বিক্রির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখনই বন্যায় তলিয়ে যায় সুনামগঞ্জের কিছু এলাকা। আর এক রাতেই পানির তোড়ে ভেঙে যায় তাঁর পুকুরগুলোর পাড়। ভেসে যায় মাছ।

সুনামগঞ্জে এবারের বন্যায় প্রায় আট হাজার পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এ কারণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখ পড়েছেন মাছচাষিরা। ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকারের কাছ থেকে সহযোগিতা দাবি করেছেন তাঁরা।মাছচাষি এনামুল হকের বাড়ি শান্তিগঞ্জ উপজেলা জিয়াপুর গ্রামে। সেখানে তাঁর মাছের খামার। এই খামার প্রতিষ্ঠা করতে তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে ধারদেনা করেছেন। মাছের খাবার কেনার দোকানেও দেনা আছে।

বন্যায় মাছ ভেসে যাওয়ায় বেশ বিপাকে পড়েছেন। এনামুল বলেন, ‘হঠাৎই পানি বেড়ে যায়। এক রাতেই সব পুকুরে পানি ঢুকে পড়ে। বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে খামারের। কী করব, বুঝতে পারছি না।’

এনামুল একা নন, সুনামগঞ্জে এবারের বন্যার প্রভাব নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বহু মাছচাষি। অনেকেরই ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া আছে। দেনা আছে মাছের খাবারের দোকানেও। সরকারি সহযোগিতা না পেলে এসব চাষি ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবেন না বলে মনে করেন তাঁরা।

আরও পড়ুন

জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, জেলার ১২টি উপজেলায় ২৫ হাজার ১৭৩টি পুকুর আছে। এর মধ্যে মৎস্য অধিদপ্তরের অধীন ২০টি, ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন ১৫৩টি, বাকি ২৫ হাজার পুকুরে ব্যক্তিমালিকানায় মাছ চাষ করা হয়। জেলাটিতে মাছচাষি আছেন ১৬ হাজার ৫০০ জন। এবারের বন্যায় প্রায় ৮ হাজার পুকুরের মাছ ও পোনা ভেসে গেছে। ভেসে যাওয়া মাছ ও পোনার পরিমাণ ৪ হাজার মেট্রিক টন। এ ছাড়া মাছের খামারের অবকাঠামোগত ক্ষতিও হয়েছে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ক্ষতি হয়েছে ৭২ কোটি টাকার। এর মধ্যে অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকার। জেলাটিতে মৎস্য সম্পদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে জেলার সদর, দোয়ারাবাজার, ছাতক ও শান্তিগঞ্জ উপজেলায়।

সদর উপজেলার বুড়িস্থল এলাকায় ১০টি পুকুর নিয়ে মাহবুব আশরাফের মাছের খামার। বন্যার পানিতে সব কটি পুকুর প্লাবিত হয়। এ সময় ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে বলে দাবি তাঁর।

জেলার ১২টি উপজেলায় ২৫ হাজার ১৭৩টি পুকুর আছে। এর মধ্যে মৎস্য অধিদপ্তরের অধীন ২০টি, ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন ১৫৩টি, বাকি ২৫ হাজার পুকুরে ব্যক্তিমালিকানায় মাছ চাষ করা হয়। জেলাটিতে মাছচাষি আছেন ১৬ হাজার ৫০০ জন। এবারের বন্যায় প্রায় ৮ হাজার পুকুরের মাছ ও পোনা ভেসে গেছে। ভেসে যাওয়া মাছ ও পোনার পরিমাণ ৪ হাজার মেট্রিক টন। এ ছাড়া মাছের খামারের অবকাঠামোগত ক্ষতিও হয়েছে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ক্ষতি হয়েছে ৭২ কোটি টাকার।

জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের চিলাগাঁও গ্রামের বাসিন্দা মাছচাষি ফারুক আহমদ বলেন, তাঁর মাছের খামারের তিনটি পুকুরের মাছ ও পোনা ভেসে গেছে। এসব পুকুরে রুই, কাতলা, পাঙাশসহ বিভিন্ন জাতের মাছ ছিল। মাছগুলোর ওজন ছিল দুই থেকে আড়াই কেজি। মাত্র মাছ বিক্রি শুরু করেছিলেন। এর মধ্যেই দেখা দেয় বন্যা। ফারুক আহমদ বলেন, ‘এখনো পানি আছে। কত ক্ষতি হলো বুঝতে পারছি না। পাহাড়ি ঢলে সর্বনাশ করে গেছে।’

একই এলাকার নজরুল ইসলাম বলেন, তাঁরও দুটি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। চলতি মাসেই মাছ বিক্রির কথা ছিল। কিন্তু এর আগেই সর্বনাশ হয়ে গেছে।

এলাকাটির মনোয়ার হোসেন, আবু সালেক ও আরব আলীর মাছের খামারও ডুবে গেছে বন্যায়। আরব আলী বলেন, ‘দুই দিনেই সব শেষ হয়ে গেছে। এখন তো পুকুরগুলোরও কোনো চিহ্ন নেই। সব পানির নিচে। শুরুতে মাছ রক্ষায় চেষ্টা করেছি। পরে দেখি এতে কোনো লাভ হবে না।’

আমরা সব জানিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে প্রতিবেদন দিয়েছি। কোনো সহযোগিতা, প্রণোদনা এলে মাছচাষিরা সেটা পাবেন।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শামশুল করিম

শুধু মাছচাষিরা নন, তাঁদের সঙ্গে মাছের খাবার সরবরাহকারীরাও বিপাকে পড়েছেন। এমন একজন ইসমাইল হোসেন। তিনি বলেন, ‘চাষিদের কাছে টাকা পাওনা। অনেকে ক্ষতির বিষয়টি জানাচ্ছেন।’

এসব বিষয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শামশুল করিমের কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সব জানিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে প্রতিবেদন দিয়েছি। কোনো সহযোগিতা, প্রণোদনা এলে মাছচাষিরা সেটা পাবেন।’

সুনামগঞ্জে ১৬ জুন থেকে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অসংখ্য বাড়িঘর, রাস্তাঘাট প্লাবিত হয়। এখন পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছে। নদী ও হাওরে পানি কমেছে।

জেলা প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, সুনামগঞ্জের ১২টি উপজেলায় বন্যায় ১ হাজার ১৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়। পানিবন্দী হয়ে পড়ে প্রায় ৮ লাখ মানুষ। ৫৪১টি আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেয় প্রায় ২৫ হাজার পরিবার। পানি নামায় অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে বাড়িঘরে ফিরছে। বন্যায় জেলা সদরের সঙ্গে কয়েকটি উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এখন সেগুলো স্বাভাবিক হয়েছে।

আরও পড়ুন