বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত আতিকুর রহমান (৩৪) ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম। তাঁর মৃত্যুতে অকূল পাথারে পড়েছেন তাঁর স্ত্রী মহুয়া আক্তার (২৬)। ছোট ছোট দুটি সন্তান নিয়ে কীভাবে সংসার চালাবেন, তা নিয়ে তাঁর দুশ্চিন্তার শেষ নেই। আপাতত দুই সন্তান নিয়ে বরিশালের হিজলায় ছোট ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।
উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সম্প্রতি মহুয়া আক্তারকে তিন শতক জমি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানে ঘর তুলবেন কীভাবে? তাঁর খাওয়া–পরার টাকাই নেই। জীবনজুড়ে শুধুই তাঁদের অনিশ্চয়তা তাড়া করছে।
গত ৫ আগস্ট ঢাকায় পুলিশের গুলিতে মারা যান আতিকুর রহমান। তাঁর বাড়ি হিজলা উপজেলায়। আতিকুর বাবা, মা, ভাই ও স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ঢাকার শনির আখড়া এলাকার ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। তিনি বিজনেস পোস্ট নামে একটি পত্রিকায় অফিস সহায়ক (পিয়ন) হিসেবে কাজ করতেন। বাবা নাসির উদ্দীন রাঢ়ি শনির আখড়া এলাকার একটি মসজিদের খাদেম এবং ফুটপাতে আতর-তসবি বিক্রি করেন। ছোট ভাই সোলায়মানও বাবার ব্যবসায় সাহায্য করেন। এ দিয়ে সামান্য যা আয় হতো এবং আতিকুরের বেতনের আয় মিলিয়ে কোনো রকম সংসারটাকে টেনে নিচ্ছিলেন। কিন্তু আতিকুরের মৃত্যু সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে।
আতিকুর রহমানের গ্রামের বাড়ি হিজলা উপজেলার বড় জালিয়া ইউনিয়নের খুন্না-গোবিন্দপুর গ্রামে। বাড়িতে তাঁদের কোনো জমি নেই, সরকারি আড়াই শতক খাস জমিতে দাদার তোলা যৌথ পরিবারের একটি ঝুপরি ঘরে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছিল। বছর দশেক আগে চাচাতো বোন মহুয়া আক্তারের সঙ্গে বিয়ে হয় আতিকের। তাঁর বাবা নাসির উদ্দীন প্রায় ২০ বছর আগে পরিবার নিয়ে রাজধানী ঢাকায় পাড়ি জমান। সেখানে কাজ নেন মসজিদের খাদেম হিসেবে। সঙ্গে টুকটাক ব্যবসা শুরু করেন। এভাবে দিন এনে দিন খেয়ে সংসার চলছিল।
গত ৫ আগস্ট ঢাকায় পুলিশের গুলিতে মারা যান আতিকুর রহমান। তাঁর বাড়ি হিজলা উপজেলায়। আতিকুর বাবা, মা, ভাই ও স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ঢাকার শনির আখড়া এলাকার ভাড়া বাড়িতে থাকতেন।
বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে আতিকুর ঢাকায় বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতেন। স্বামীর মৃত্যুর পর মহুয়া সেই আশ্রয়ও হারান। শ্বশুরের সংসার চলছে না, তাই দুই সন্তান আদুল্লাহ (৩) ও আদিবাকে (৫) নিয়ে চলে আসেন বাবার বাড়িতে। বাবা মান্নান রাঢ়ি মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। ছোট ভাই নোমান স্থানীয় বাজারে একটি ছোট চায়ের দোকান দিয়ে কোনো রকম টানাপোড়েনের মধ্যে সংসার চালান।
গত বুধবার দুপুরে খুন্না-গোবিন্দপুরের ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, টিনের ভাঙাচোরা ঘরের বারান্দায় দুই সন্তানকে নিয়ে বসে আছেন মহুয়া আক্তার। স্বামীর কথা বলতেই তাঁর চোখ ছলছল করে ওঠে। বলেন, ‘নিজেগোর এক টুকরা জমিও আছিল না যে মানুষটা মরণের পর নিজেগোর জায়গায় দাফন করমু। বাধ্য হইয়্যা আতিকের লাশ পাশের শ্রীপুর এলাকার একটি কওমি মাদ্রাসার কবরস্থানে দাফন করছি।’
‘আমাগো সংসারে অভাব ছিল, কিন্তু শান্তি আছিল। খাওন-পরনে টানাটানি আছিল, কিন্তু তাতে কষ্ট আছিল না আমাগো। খুব শান্তি আছিল, খুব...।মহুয়া আক্তার, নিহত আতিকুর রহমানের স্ত্রী
স্মৃতিচারণা করতে করতে মহুয়া ফিরে যান সেই দিনগুলোতে। বলেন, ‘আমাগো সংসারে অভাব ছিল, কিন্তু শান্তি আছিল। খাওন-পরনে টানাটানি আছিল, কিন্তু তাতে কষ্ট আছিল না আমাগো। খুব শান্তি আছিল, খুব...। সারা দিন আতিকুর খালি কইত, “আমাগো কষ্ট হয় হউক, বাচ্চা দুইটারে আমরা বড় করমু, মানুষ করমু, অরা আমাগো দুঃখ ঘুচাইবে, দেইখো।’” বলতে বলতে মহুয়া নিশ্চুপ হয়ে যান।
কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক হন মহুয়া। তিনি জানান, ৫ আগস্ট প্রতিদিনের মতো আতিকুর বেলা ১১টার দিকে বাসা থেকে অফিসের উদ্দেশে যান। বাইরে অনেক গন্ডগোল চলছিল। বাইরে গোলাগুলি হয়েছে বলে খবর পান। মনটা অস্থির হয়ে ওঠে মহুয়ার। রাত ৯টার মধ্যে আতিকুরের বাসায় ফিরে আসার কথা, কিন্তু আসেন না। ফোনেও পাচ্ছিলেন না। রাত বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে অজানা আশঙ্কা। শ্বশুর-দেবর বাইরে খোঁজখবর নিতে যান। তবে তাঁরা কোনো সন্ধান পাননি। রাত সাড়ে ১১টার দিকে একটি ফোন আসে। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে কেউ একজন জানান, আতিকুর অসুস্থ, ঢাকা মেডিকেলে আছেন। শ্বশুর, দেবর ছুটে যান হাসপাতালে; হন্তদন্ত হয়ে ছোটাছুটি করেন। পরে তাঁরা যান হাসপাতালের মর্গে। অনেক লাশের ভিড়ে দেখেন আতিকুরের গুলিবিদ্ধ নিথর দেহ পড়ে আছে মর্গে। ওই রাতেই রওনা হন গ্রামের বাড়িতে। পরদিন সকালে ময়নাতদন্ত ছাড়াই বাড়ির পাশের কওমি মাদ্রাসার গোরস্তানে আতিকুরকে দাফন করা হয়। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে শহীদদের খসড়া তালিকায় আতিকুরের নাম যুক্ত হয়েছে। সম্প্রতি লাশ তুলে ময়নাতদন্তও হয়েছে।
১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে মহুয়া আক্তারের হাতে তিন শতক জমির বন্দোবস্তের দলিল হস্তান্তর করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাহাঙ্গীর হোসেন। এর আগে তাঁকে ২৫ হাজার টাকাও দেওয়া হয়েছে।
মহুয়া বলেন, ‘শ্বশুরের আয়ে সংসার চলে না। দুইটা বাচ্চা নিয়ে আমি কীভাবে কী করব? তাই ভাইয়ের কাছে আশ্রয় নিয়েছি। কিন্তু ভাইয়ের সংসারেও তো টানাপোড়েন। দুই দিন আগে হিজলা উপজেলা প্রশাসন মাথা গোঁজার জন্য তিন শতক খাস জমি বন্দোবস্ত দিয়েছে। এখন এই জমিতে ঘর তুলব কীভাবে? সামনের দিনগুলো চলবে কীভাবে?’
১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে মহুয়া আক্তারের হাতে তিন শতক জমির বন্দোবস্তের দলিল হস্তান্তর করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাহাঙ্গীর হোসেন। এর আগে তাঁকে ২৫ হাজার টাকাও দেওয়া হয়েছে।
হিজলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ইয়াসিন সাদেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মহুয়ার পরিবারের মাথা গোঁজার মতো কোনো জমি ছিল না। আমরা সেটা জানতে পেরে খুন্না-গোবিন্দপুর গ্রামে তিন শতক বাড়ির জমি বন্দোবস্ত দিয়েছি। এতে অন্তত তাঁর সন্তানদের নিয়ে মাথা গোঁজার একটি ঠাঁই হবে।’
ওই জমিতে ঘর তোলার উদ্যোগ নিচ্ছেন মহুয়া আক্তার। তিনি বলেন, ‘জমির বন্দোবস্ত দেওয়ায় আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই হবে। এখন এখানে ঘর তুলব। কিন্তু সন্তানদের লেখাপড়া, খাওন-পরন, পরিবারের ভরণপোষণের টাকা তো আমার নেই। এ জন্য একটা স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হলে অন্তত এই দুশ্চিন্তা কিছুটা লাঘব হতো।’
সহকারী কমিশনার (ভূমি) ইয়াসিন সাদেক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা যত দূর সম্ভব মহুয়া ও তাঁর সন্তানদের সহযোগিতার চেষ্টা অব্যাহত রাখব।’