অনলাইনভিত্তিক নানা উদ্যোগে আগ্রহী হচ্ছেন ভোলার গ্রামীণ নারীরা
নিজের স্মার্টফোনে ফেসবুক আর ইউটিউব চালান, এটা-ওটা দেখেন। কিন্তু এই স্মার্টফোনটি ব্যবহার করে যে নিজের যত্ন নেওয়া যায়, বিভিন্ন রকম কনটেন্ট তৈরি করে ইনকাম করা যায়, নানা রকম উপায়ে ব্যবসা করা যায়, সে সম্পর্কে ধারণা ছিল না। বিষয়গুলো জানার পর এখন তাঁর পরিকল্পনায় অনেক কিছু যুক্ত হয়েছে। ভাবছেন, লেখাপড়ার পাশাপাশি ঘরে বসেই স্মার্টফোন ব্যবহার করে অনলাইন ব্যবসা শুরু করবেন। ইতিমধ্যে হাতের কাজের প্রশিক্ষণ নেওয়ার ব্যাপারেও প্রাথমিক আলাপ শেষ করেছেন।
বলছিলাম মোসাম্মৎ হাসনা আক্তারের (১৮) কথা। তিনি ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের শিকদারকান্দি এলাকার বাসিন্দা। একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী হাসনা পড়ালেখার পাশাপাশি উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। পরিবারের সামান্য আয়ের সংসারে সব সময় বাবার কাছে টাকাপয়সা চাইতে সংকোচ বোধ করেন। নিজেই ‘কিছু একটা করে’ আয়ের উপায় খুঁজছিলেন। বড় বোন ও মায়ের কাছে সেলাই-ফোঁড়নের কাজ শিখেছেন। আগে মাঝেমধ্যে নিজের স্মার্টফোন ব্যবহার করে ইউটিউবে শাড়ি, পাঞ্জাবি, কাঁথা, কামিজ ইত্যাদিতে নকশা ও ফুল তোলার কাজের ভিডিও দেখতেন। এসব দেখে নিজেও কিছু একটা করার তাগিদ অনুভব করছিলেন। কিন্তু কী করবেন, ভেবে পাচ্ছিলেন না।
হাসনাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহস জুগিয়েছে গ্রামীণফোনের উদ্যোগে ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ প্রচারাভিযানের আওতায় আয়োজিত উঠান বৈঠক। যেদিন নিজ গ্রামের শিকদার বাড়ির উঠানে এ আয়োজনের কথা জানতে পারলেন, সেদিন ইন্টারনেটের বহুমুখী ব্যবহার শেখার সুযোগটি হাতছাড়া করলেন না। তাঁর মতো শতাধিক নারী অংশ নেন গত ৩০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত উঠান বৈঠকে। হাসনা বলেন, ‘এখানে এসে আমার অনেক উপকার হয়েছে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, অনলাইনে ব্যবসা করে উদ্যোক্তা হব। এখন তাই হাতে-কলমে শাড়ি, পাঞ্জাবি ও কামিজে নকশা-ফুল তোলার কাজ শিখছি।’
২ ডিসেম্বর ২০২৪। ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার হাজারীগঞ্জ ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের খাজুরগাছিয়া গ্রামে শিবলু মিয়ার বাড়ি। সেখানে অনুষ্ঠিত উঠান বৈঠকে যোগ দেন আসমা বেগম (২২)। এইচএসসি পাস আসমা বাড়িতে বসে শিশুদের প্রাইভেট পড়ান। হাঁস-মুরগি পালেন। সেলাইয়ের কাজ জানলেও নিজের সেলাই মেশিন না থাকায় কিছু করতে পারছেন না। সংসারে সচ্ছলতা আনতে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। স্বামী মো. সুজন স্থানীয় খাজুরগাছিয়া বাজারের ছোট ব্যবসায়ী। মোবাইলে ফ্লেক্সিলোড, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবসাটি চলে বর্ষা মৌসুমে। বাকি সময় বন্ধ থাকে। তখন অন্য কাজ করেন। স্বামীর স্মার্টফোনে হাসনা একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট করেছেন। ইচ্ছা আছে টাকা জমিয়ে অনলাইনের মাধ্যমে কাপড়ের ব্যবসা করবেন।
আঁখি আক্তার (২২)। একজন অনলাইন উদ্যোক্তা। তাঁর বাড়ি ভোলার সদর উপজেলার বাপ্তা ইউনিয়নের বোর্ডের ঘর এলাকায়। ২০২১ সালে ডিগ্রি পাস করার পর অনলাইনে ছয় মাসের একটি কোর্স শেষ করে ব্যবসা শুরু করেন। ব্লক, বাটিক, সেলাই-ফোঁড়নের কাজ আগেই জানা ছিল। নিজ বাড়িতে বলতে গেলে শূন্য থেকেই শুরু করেন তিনি। স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা গ্রামীণ জন-উন্নয়ন সংস্থার ‘গুরু-শিষ্য প্রকল্প’ থেকে তিনি ২২ হাজার টাকা অনুদান পান। এ ছাড়া এ প্রকল্পের মাধ্যমে আঁখি অন্য মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।
আঁখি জানান, ‘অনুদানের টাকায় আমি বাড়িতে পণ্য রাখার জন্য দুটি আলমারি, টেবিল, চেয়ারসহ একটা শোরুম দিয়েছি। এখান থেকে অনলাইনে হাতে ফুল করা, নকশার কারুকাজ করা শাড়ি, পাঞ্জাবি, কামিজ, ওয়ালমেট ও মাটির সরঞ্জাম বিক্রি করি। ঈদ, পূজা ইত্যাদি উৎসবের সময় বেশি বিক্রি হয়। তবুও মাসে গড়ে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় হয়।’
অনলাইনে ব্লগিং করে ফেসবুক পেজ, ইউটিউব ও অন্যান্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমেও আয় করেন আঁখি। এই আয়ে চলে এক ভাই, এক বোন আর অসুস্থ বিধবা মাকে নিয়ে তাঁদের সংসার।
ভোলার গ্রামে গ্রামে নারীদের ইন্টারনেটের প্রতি আগ্রহের এসব গল্প খুব পুরোনো নয়। প্রত্যন্ত গ্রামের বেশির ভাগ নারী কিছুদিন আগেও স্মার্টফোন কী, এটি দিয়ে কীভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হয়, তা জানতেন না। কিন্তু প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর তাঁদের অধিকাংশই ইন্টারনেটের ব্যবহার সম্পর্কে উৎসাহিত হচ্ছেন। অনেকে ইন্টারনেট ব্যবহার করে কীভাবে আয় করবেন, সেই পরিকল্পনাও করে ফেলছেন। যাঁদের মধ্যে রয়েছেন ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার শম্ভুপুর ইউনিয়নের লিমা আক্তার (১৯), চরফ্যাশন উপজেলার ওমরপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা শিক্ষার্থী সালমা আক্তার (১৭), একই ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা বিবি ফাতেমা, কাঞ্চন পাটওয়ারী বাড়ির বাসিন্দা ফারজানা আক্তার, ওসমানগঞ্জ ইউনিয়নের সুফিয়া আক্তার ও সুমাইয়া আক্তার। তাঁরা কেউ আচার, কেউ পিঠা, নকশিকাঁথা, কেউ হাতে আঁকা নকশা করা ওয়ালমেট বানিয়ে অনলাইনে বিক্রির পরিকল্পনা করছেন। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নে সহযোগিতা প্রত্যাশা করেছেন অনেকেই।
ভোলায় ২০২৪ সালের ১৬ নভেম্বর শুরু হওয়া কার্যক্রমটি শেষ হয় ২ ডিসেম্বর। এর মধ্যে ছয়টি উপজেলার ৩০টি ইউনিয়নে উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মানুষের নানা চাহিদা ও প্রয়োজন মেটাতে ইন্টারনেট যে সক্ষম, সে বিষয়টি তৃণমূলের নারীদের সরাসরি শেখাতেই ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ উদ্যোগ। প্রথম আলোর পাঠক সংগঠন বন্ধুসভার স্থানীয় সদস্যদের সহযোগিতায় সারা দেশের দুই হাজার ইউনিয়নে চলছে উঠান বৈঠক। গ্রামীণফোনের এই উদ্যোগ আয়োজনের সহযোগিতায় রয়েছে প্রথম আলো, নকিয়া, ব্র্যাক মাইক্রোফাইন্যান্স ও ঢাকা ব্যাংক পিএলসি। ২০২৩ সালের মার্চে শুরু হওয়া কার্যক্রমটির আওতায় ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ৪৯টি ইউনিয়নে উঠান বৈঠক সম্পন্ন হয়েছে।