ভারী বর্ষণে জলাবদ্ধতা আর যানবাহনসংকট, কর্মক্ষেত্রে যেতে নাকাল মানুষ

ভারী বৃষ্টিতে আবারও ডুবেছে চট্টগ্রামের নিচু এলাকা। আজ সকাল দশটায় নগরের প্রবর্তক মোড়েপ্রথম আলো

চট্টগ্রাম নগরের ফয়’স লেক এলাকায় থাকেন জহিরুল হক। প্রবর্তক মোড়ের একটি রোগনির্ণয় কেন্দ্রে চাকরি করেন তিনি। সকাল নয়টার দিকে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন অফিসে যাবেন বলে। ভারী বর্ষণে তখন তখন স্রোতের মতো পানির প্রবাহ সড়ক আর ফুটপাতে। কোনোমতে একটা দোকানের আশ্রয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন যানবাহনের জন্য। কিন্তু অফিসের এই ব্যস্ত সময়েও প্রায় ৩৫ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হলো তাঁকে। সিএনজিচালিত অটোরিকশা তেমন একটা চলছে না আজও। দু–একটা বাস এলেও ওঠা সম্ভব হয়নি। শেষে ব্যাটারিচালিত একটা রিকশায় গোলপাহাড় মোড় পর্যন্ত এসে দেখেন, সামনের মোড়ে কোমরসমান পানি। ওই এলাকা থেকে তাঁর অফিসের দূরত্ব সময়ের হিসাবে দুই মিনিটের মতো। তবে কোমরপানি ডিঙিয়ে যেতে লেগেছে প্রায় আধা ঘণ্টা।

আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জহিরুল হকের সঙ্গে দেখা প্রবর্তক মোড়ে। ছাতা থাকলেও পুরোপুরি ভিজে গিয়েছিলেন তিনি। জানতে চাইলে বলেন, দুর্যোগে ভোগান্তি হবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক ও শ্রমিকদের কর্মকর্মবিরতির কারণে সড়কে যানবাহনের সংকট ছিল আজও। বিষয়টা তুলে ধরে বেশ বিরক্তি প্রকাশ করলেন তিনি। সড়কে পর্যাপ্ত যানবাহন না থাকায় মানুষকে নাকাল হতে হচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

চট্টগ্রাম নগরের চিরচেনা এই জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ নিরসনে ৫ থেকে ১০ বছর ধরে চলছে ৪টি প্রকল্পের কাজ। এসব প্রকল্পের বিপরীতে মোট বরাদ্দ ১৪ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৭ হাজার ৯০২ কোটি টাকা। গত সাত বছরে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হলেও নগরের জলাবদ্ধতা এখনো দূর হয়নি, এমনকি সহনীয় পর্যায়েও আসেনি। একটু ভারী বৃষ্টি হলেই পানিতে ডুবে যাওয়ার চিন্তা ভর করে নগরবাসীর।
একটানা ভারী বৃষ্টিতে ডুবে গেছে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকা। কোমর সমান পানি ডিঙিয়ে গন্তব্যে যচ্ছেন এক ব্যক্তি। আজ বেলা ১১টায় নগরের চকবাজার এলাকায়
ছবি-সৌরভ দাশ

কয়েক দিন ধরে চট্টগ্রামে টানা ভারী বর্ষণ হচ্ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের চট্টগ্রামের পতেঙ্গা কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে আজও ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস ছিল। গত ২৪ ঘণ্টায় (বুধবার সকাল ৯টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত) ১৪১ দশমিক ৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সর্বশেষ ৩ ঘণ্টায় (বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত) বৃষ্টি হয়েছে ৫৫ মিলিমিটার। সকালে বৃষ্টির যে তীব্রতা, তা বিকেলের দিকে কমতে পারে। তবে বৃষ্টি অব্যাহত থাকবে বলেই জানিয়েছে আবহাওয়া দপ্তর।

টানা ভারী বৃষ্টিতে নগরের নিচু এলাকাগুলো তলিয়ে গেছে। চকবাজার, ডিসি সড়ক, বাকলিয়া, ফুলতলা, কে বি আমান আলী সড়ক, ওমর আলী মাতব্বর সড়ক, খাজা সড়ক, বহদ্দারহাট, ফরিদারপাড়া, মেহেদীবাগ, চান্দগাঁও, মুরাদপুর, মোহাম্মদপুর, দুই নম্বর গেট, ওয়ারলেস মোড়, আগ্রাবাদ শেখ মুজিব সড়ক, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, প্রবর্তক মোড়, কাপাসগোলা, কাতালগঞ্জ, তিন পুল, হালিশহরসহ বিভিন্ন এলাকার রাস্তাঘাট ও বসতঘরে পানি ঢুকেছে। আজ সকালে এমন বৃষ্টি এবং পানি জমে থাকার কারণে কর্মস্থলে যেতে পারেননি অনেকেই। দুর্যোগে নগরের স্কুলগুলো খোলা থাকলেও উপস্থিতি তেমন ছিল না। রাস্তাঘাটেও গাড়ি চলাচলের পরিমাণও কম ছিল। আবার পানির কারণে সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। সব মিলিয়ে অসহনীয় দুর্ভোগে পড়েছেন নগরবাসী।

ঘরে হাঁটুসমান পানি জমে থাকায় পরিবার নিয়ে কষ্টে থাকার কথা জানিয়ে নগরের চকবাজারের মুহম্মদ আলী শাহ লেনের বাসিন্দা আবদুল হামিদ বলেন, সকাল আটটা থেকে ঘরে পানি ঢুকতে শুরু করে। অল্প সময়ের মধ্যে ঘরে পানি জমে যায়। এমন তীব্র বৃষ্টি হচ্ছে, এখন বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। সময় বাড়লে যে কী হবে, সেটি নিয়ে চিন্তায় আছেন।

বাড়ির সামনের সড়কে পানি জমে থাকায় ঘর থেকে বের হতে পারেননি চাকরিজীবী মিজানুর রহমান। নগরের ডিসি সড়কের এই বাসিন্দা বলেন, ‘সকাল থেকে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। পুরো এলাকায় পানি জমে গিয়েছে। এ কারণে সন্তানদের স্কুলে নিতে পারেননি। নিজেও অফিসে যেতে পারছেন না।’

সকালের ভারী বর্ষণে নগরের আগ্রাবাদে শেখ মুজিব সড়কে অবস্থিত ফায়ার সার্ভিসের কার্যালয়েও পানি ঢুকেছে বলে জানিয়েছেন এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, সকালে তাঁদের কার্যালয়ে পানি ঢুকেছে। এর মধ্যে কার্যক্রম চালিয়ে নিতে হচ্ছে।

প্রবর্তক মোড়ে কথা হয় বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মরত নুসরাত জাহানের সঙ্গে। হিলভিউ এলাকার বাসা থেকে বের হতেই হাঁটুপানি ডিঙাতে হয়েছে তাঁকে। অনেক কষ্টে একটি রিকশা পেয়ে কর্মক্ষেত্রে রওনা হন তিনি।

সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালকদের কর্মবিরতি সম্পর্কে জানতে চাইলে শ্রমিকনেতা ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে মালিকপক্ষ সরাসরি বৈঠক করেনি। তারা চালকদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করছে। আমাদের দাবিগুলো মেনে না নেওয়া হলে কর্মবিরতি চলবে।’

ঘরের এক কোণে খাটের ওপর আশ্রয় নিয়েছেন পানিবন্দী পরিবারের কয়েকজন সদস্য। আজ দুপুর ১২টায় চট্টগ্রাম নগরের চকবাজার ডি সি রোড এলাকায়
ছবি-সৌরভ দাশ

১৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের সুফল কোথায়

এ নিয়ে তিন দিনের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো ডুবল চট্টগ্রাম নগর। এর আগে গত মঙ্গলবারও চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছিল। আর চলতি বছর এ নিয়ে মোট ছয়বার পানিতে ডুবেছে বন্দরনগর।

চট্টগ্রাম নগরের চিরচেনা এই জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ নিরসনে ৫ থেকে ১০ বছর ধরে চলছে ৪টি প্রকল্পের কাজ। এসব প্রকল্পের বিপরীতে মোট বরাদ্দ ১৪ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৭ হাজার ৯০২ কোটি টাকা। গত সাত বছরে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হলেও নগরের জলাবদ্ধতা এখনো দূর হয়নি, এমনকি সহনীয় পর্যায়েও আসেনি। একটু ভারী বৃষ্টি হলেই পানিতে ডুবে যাওয়ার চিন্তা ভর করে নগরবাসীর।

প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা নিয়ে নগরবাসী উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকলেও চারটি প্রকল্পের কাজ ঠিক সময়ে শেষ করতে পারছে না বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো; বরং দফায় দফায় সময় বৃদ্ধি করা হচ্ছে। চারটির মধ্যে তিনটির আবার সময় বাড়ানো হয়েছে। অন্যটির সময় আগে বৃদ্ধি করা হয়।

এ বছর চট্টগ্রাম নগরে প্রথম জলাবদ্ধতা হয় গত ৬ মে। এরপর ২৭ মে আরেক দফা ডুবে যায় নগর। গত জুন মাসের শেষ দিন ৫৮ মিলিমিটার বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ১ আগস্ট ১৪৮ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিতে নগরজুড়ে জলাবদ্ধতা হয়। গত মঙ্গলবার পঞ্চমবারের মতো ডোবে বন্দরনগর। গত বছর অন্তত ১৩ বার ডুবেছিল চট্টগ্রাম।