খাল–নদী দখলে নতুন মুখ

বিএনপির নামধারী কিছু ব্যক্তি এসব দখলে জড়িত। দখল, লুটপাট থেকে বিরত থাকতে বিএনপি নির্দেশনা দিলেও খুব একটা কাজে আসছে না।

বাগেরহাট সদরের কাশিমপুর এলাকার মৎস্যঘেরের বেড়ি (আল) কেটে পাশের চিংড়িঘেরের সঙ্গে মিলিয়ে দখলে নেওয়া হয়েছেছবি: প্রথম আলো

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাগেরহাটে আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের দখলে থাকা খাল–নদী হাতবদল হয়ে বিএনপির নেতা–কর্মীদের দখলে চলে গেছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন মাছের ঘেরসহ নানা সম্পদ লুট, দখল চাঁদাবাজি চলছে। বিএনপির নামধারী কিছু ব্যক্তিসহ এলাকায় সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত ব্যক্তি এসব দখলে জড়িত। দখল, নৈরাজ্য, লুটপাট থেকে বিরত থাকতে বিএনপি কঠোর নির্দেশনা দিলেও খুব একটা কাজে আসছে না।

বাগেরহাটে ব্যক্তিমালিকানাধীন ও হারি (ভাড়া) নিয়ে করা মাছ চাষ করা কয়েক হাজার ঘেরে এমন লুট, দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে। জেলার ৯ উপজেলার মধ্যে সদর, মোরেলগঞ্জ, রামপাল ও মোংলায় সবচেয়ে বেশি অভিযোগ উঠেছে। এসবের ভুক্তভোগী আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ ও কোথাও কোথাও বিএনপির নেতা–কর্মীরা।

নদী দখলে হাতবদল

সদর উপজেলার হোজির নদী। দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে আট কিলোমিটার। ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা সমন্বিতভাবে নদীটি দখলে নেন। এতে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় কৃষিকাজে ক্ষতির পাশাপাশি এলাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হতো। নদীর ডেমা ইউনিয়নের অংশ দখল করে মাছ চাষে যুক্ত ছিলেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের পদধারী ২০-২৫ জন নেতা-কর্মী। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর সেটি স্থানীয় বিএনপির লোকজন দখলে নিয়েছেন। ডেমা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আজাদ হাওলাদার, ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক রসুল শেখ, বিএনপির কর্মী নাহিদ ফকির, শামিম ফকির, পান্না হাওলাদার, বাবুল শেখ, আনিস শেখ, রাসেল ফকিরের নাম জানা গেছে। তাঁরা ছাড়াও বেশ কয়েকজন ব্যক্তি এখন পুরো নদী দখলে নিয়েছেন।

■ ব্যক্তিমালিকানাধীন ও ভাড়া নেওয়া কয়েক হাজার ঘেরে এমন লুট ও দখলদারি চলছে। 

■ ৯ উপজেলার মধ্যে সদর, মোরেলগঞ্জ, রামপাল ও মোংলায় বেশি অভিযোগ।

বিএনপি নেতা রসুল শেখ বলেন, ‘আমাদের সংগঠনের কোনো লোক দখলের সঙ্গে জড়িত না। এখানে একজনের ঘের দখল করেছিল চোর টাইপের একটা লোক, আমরা উদ্ধার করে দিছি।’ আজাদ হাওলাদার অবশ্য নদী দখলের বিষয়টি অস্বীকার করেননি। তিনি বলেন, ‘নদীর গোড়ার দিকে হেদায়েতপুরে যারা বিএনপি করে, তারা ব্যাড় দিছে (দখল নিয়েছে)। আর কাশেপুরে যারা বিএনপি করে, তারা আগার দিকে ব্যাড় দিছে। এমনি মাছ ধরা–টরা হই নাই।’

ঘের দখল–লুট, চাঁদাবাজি

সরকারি নদী-খালের পাশাপাশি ব্যক্তিমালিকানাধীন ঘের দখল ও লুটের ঘটনা ঘটছে। ডেমা ইউনিয়নে এখন পর্যন্ত এ–সংক্রান্ত অসংখ্য চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেখানকার বিএনপি–দলীয় সাবেক ইউপি সদস্য সজিব তরফদার ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর টানা কয়েক দিন এলাকায় শটগান নিয়ে ঘুরেছেন বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন। ওই ব্যক্তিসহ বিএনপির নামধারী নেতা–কর্মীদের মাধ্যমে ওই এলাকায় দেড় শতাধিক ঘের থেকে মাছ লুট, ঘের দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলেও ভয়ে কেউ মুখ খলতে সাহস পাচ্ছেন না।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ‘সজীব মেম্বার’ নামে পরিচিত সজীব তরফদার যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তাঁর ভাই সোহেল তরফদারও যুবদলের নেতা।

ডেমা ইউনিয়নে ঘের দখল, লুট ও দখল ছেড়ে দিতে চাঁদা দেওয়া ১৩ জন মাছচাষির সঙ্গে কথা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে সাতজনের কোনো দলীয় পরিচয় নেই। তারপরও তাঁদের ঘের দখল করতে গিয়েছিলেন সজীব তরফদারের লোকজন। এই দলের ১৭ জনের নাম–পরিচয় পাওয়া গেছে। যাঁদের চারজন এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী। আওয়ামী লীগের সময়ও তাঁরা সন্ত্রাসী কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন।

ঘেরমালিকেরা বলছেন, ৫ তারিখ রাত থেকে ৫-৬টি গ্রুপে তাঁদের এলাকায় ঘের দখল ও মাছ লুট শুরু হয়। প্রথমে একটি মাছের ঘরে গিয়ে সেখাকার কর্মচারীদের হুমকি–ধমকি দিয়ে বের করে দিচ্ছে। পরে সেখান থেকে মাছ ধরে বিক্রি করছে। এরই মধ্যে একটি পক্ষ চাঁদা দাবি করছে। সেই টাকা নিয়ে তারা ঘের ছেড়ে দিয়ে আসছে। একই ঘের থেকে দুই–তিন পক্ষ গিয়ে মাছ ধরে নিয়ে আসার ঘটনাও ঘটছে।

রাজনীতি করেন না, এমন এক ঘেরমালিক বলেন, ‘আমরা কয়েকজন মালিক মিলে নিজেদের জমিতে একসাথে মাছ চাষ করি। খালগুলো দখল থাকায় এবং সেখানে লবণ–পানি তোলায় গেল কয়েক বছর আমাদের মাঠে কোনো ধান হয় না। মাছ-চিংড়ি চাষই আমাদের একমাত্র আয়ের জায়গা। কেউ রাজনীতিতে না থাকলেও আমাদের ঘের দখল নেয়। পরে সজীব মেম্বারের লোকদের ৫০ হাজার টাকা দিয়ে ঘের ছাড়াতে হইছে।’ শুধু ওই এলাকায় আরও অন্তত সাতজনের কাছ থেকে এমন টাকা নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সদরের বিষ্ণুপুর ও গোটাপাড়া ইউনিয়নেও ঘের দখলের ব্যাপক অভিযোগ পাওয়া গেছে। কয়েক দিন আগে গোটাপাড়া ইউনিয়নের মুক্ষাইট মোড়ে ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান (বিএনপি) বাসারাত হাওলাদার একটি পথসভায় বলেন, ‘কোনোভাবে আওয়ামী লীগের লোক যেন বাজারে উঠতে না পারে। বাড়িও না থাকতি পারে, আমাদের যেমন মরিছে, তাদের সে রকম ব্যবস্থা ইনশা আল্লাহ করবেন।’

আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত ঘেরমালিকদের অনেকে সমঝোতা করে চলার চেষ্টাও করছেন। তবে নতুন বিপদের শঙ্কায় কেউ এ বিষয়ে কথা বলতে চাইছেন না। তাঁরা থানা–পুলিশের কাছে অভিযোগও করছেন না।

শনিবার দুপুরে এক ঘেরমালিক বলেন, ‘আমার তিনটা ঘের দখল হয়ে গেছে। প্রতিটি ১৫০ বিঘার ওপরে। তারা দখল করে মাছ ধরছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো হলে দেখি ফিরে পাই কি না।’

বিএনপির লোকজনও ভুক্তভোগী

কেবল আওয়ামী লীগ বা সাধারণ মানুষই নয়, বিভিন্ন এলাকায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের ঘের দখল-লুটের অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে। রামপাল উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মোতাহার হোসেন বলেন, ভোজপাতিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আল-আমিন শেখ শ খানেক লোক নিয়ে গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ক্যাটার্জীখালী গ্রামে তাঁর ২৪০ বিঘার চিংড়িঘের থেকে লাখ টাকার মাছ লুটে নিয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘কী বলব বলেন, আমাদের দলের লোকই এই লুটপাট চালাচ্ছে।’

ভোজপাতিয়া এলাকার আরেক বিএনপি নেতা বলেন, লুটপাট দখল সব জায়গায় চলছে। যে যেমন পারছে, করছে। কেউ কাউকে মানছে না। এক থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা চাওয়া হচ্ছে। চাঁদা না দিলে ঘের দখল করে নেওয়ার হুমকি দেয়।

দলীয় নেতা–কর্মীদের এসব অন্যায় থেকে বিরত থাকতে সতর্ক করার পাশাপাশি বেশ কিছু অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থাও নিচ্ছে বিএনপি। দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে গত শুক্রবার ডেমা ইউনিয়নের সজীব তরফদারকে দলের প্রাথমিক সদস্য পদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। 

জেলা বিএনপির আহ্বায়ক এ টি এম আকরাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো ধরনের অন্যায়কে বিএনপি সমর্থন, প্রশ্রয় দেবে না।