সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামীকে হারিয়ে দিশাহারা ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা শামীমা
শামীমা বেগম (৩০) এখন আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আগামী মাসেই তাঁর স্বামী আবদুল আউয়ালের (৩৮) ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে আসার কথা ছিল। আউয়াল এসেই তাঁর স্ত্রীকে সন্তান প্রসবের জন্য হাসপাতালে ভর্তি করবেন, এমনটাই ছিল পরিকল্পনা। আউয়াল ঠিকই বাড়িতে এলেন, তবে লাশ হয়ে। স্বামীর এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মানতে পারছেন না শামীমা।
বিলাপ করতে করতে শামীমা বলেন, ‘আমার সংসারডা শ্যাষ হইয়া গেল। ছোট ছোট মাইয়া দুইডা লইয়া কই যামু? কে আমার বাচ্চাগো দেখব? আমার গর্ভের সন্তানকে নিয়ে আউয়ালের অনেক শখ ছিল। আমার গর্ভের সন্তান পৃথিবীতে আশার আগেই ওর বাবারে হারাইল।’
আবদুল আউয়ালের বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার উত্তর কৃষ্ণনগর এলাকায়। তাঁর বাবার নাম তোফায়েল হাওলাদার। আউয়াল সাভারের আশুলিয়ায় অবস্থিত এসবি নিটিং লিমিটেড নামের একটি পোশাক কারখানায় ফেব্রিকস ইনচার্জ হিসেবে কাজ করতেন। গত বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটার দিকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার ঘাসিরদিয়া শহীদ মিনার এলাকায় মাইক্রোবাস-পাথরবোঝাই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে আবদুল আউয়ালসহ সাতজন নিহত হন। নিহত ব্যক্তিরা সবাই ওই পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। তাঁরা সবাই মাইক্রোবাসে করে সিলেটে বেড়াতে যাচ্ছিলেন।
গতকাল শুক্রবার রাতে উত্তর কৃষ্ণনগর এলাকায় নিজের বাড়িতে জানাজা শেষে আবদুল আউয়ালকে দাফন করা হয়। এতে এলাকার মানুষ ও প্রতিবেশীরা অংশ নেন। এর আগে এসবি নিটিং লিমিটেড কারখানার কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে আবদুল আউয়ালের লাশ বাড়িতে আনা হয়।
আউয়ালের স্বজন ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০ বছরের বেশি সময় ধরে আবদুল আউয়াল ওই পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে আউয়াল তৃতীয়। ভাইয়েরা সবাই যে যার মতো আলাদা সংসার করছেন। আউয়াল-শামীমার সংসারে দুই মেয়ে রয়েছে। আউয়ালের পাঠানো টাকায় সংসার চলত। সর্বশেষ কোরবানি ঈদের পাঁচ দিন পর গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন তিনি।
সিলেটে বেড়াতে যাওয়ার আগের দিন বুধবার মুঠোফোনে শেষবার আউয়ালের সঙ্গে কথা হয় শামীমার। এই স্মৃতি টেনে শামীমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগামী মাসে ছুটি নিয়া বাড়িতে আইবো কইছিল। দুদিনের জন্য কারখানার কয়েকজনের লগে তিনি সিলেটে যাওয়া কথা জানান।’
শামীমা-আউয়াল দম্পতির দুই মেয়ে। বড় মেয়ে রহিমার বয়স ৯ বছর আর ছোট মেয়ে হাবিবার বয়স পাঁচ। দুই মেয়ে এখনো বুঝে উঠতে পারেনি তাদের বাবা আর ফিরে আসবে না। আজ শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আউয়ালের বাড়ি উত্তর কৃষ্ণনগর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে মানুষের ভিড়। ঘরের মধ্যে আউয়ালের স্ত্রী শামীমা ও তাঁর স্বজনেরা কান্নাকাটি করছেন। পাশেই চুপ করে বসে ছিল আউয়ালের দুই মেয়ে। প্রতিবেশীরা শামীমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। আউয়ালের বৃদ্ধ বাবা ঘরে শয্যাশায়ী। কোনো কথা বলতে পারছিলেন না তিনি।
আওয়ালের ছোট ভাই মাহাবুব আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভাইয়ার লাশ যখন বুঝে আনি তখন বারবার মনে হচ্ছিল, বাড়িতে গিয়ে আমি সবাইকে কী জবাব দেব। কারণ, ভাবি বা পরিবারের কেউ জানত না ভাইয়া আর নাই। বাড়িতে আসার পর সবাই ভেঙে পড়েছে। ভাইয়ার মুখটা বারবার আমার চোখে ভেসে ওঠে।’
আউয়ালের প্রতিবেশী আজিজুল হাওলাদার বলেন, আবদুল আউয়াল অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন। দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যুর খবরটি দুঃখজনক। এলাকার সবাই তাঁকে ভালোবাসতেন। তাঁর এ মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।