‘আমরা সবাই আতঙ্কগ্রস্ত ছিলাম। আমাদের মনে হয়েছিল, গোলাগুলি হতে পারে। কেউ হয়তো প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারব না। যে কারও সঙ্গে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ওই ঘটনার মুহূর্ত মনে পড়লে এখনো আতঙ্ক লাগে। মনে হয়, এই বুঝি সব শেষ! আমরা এখন শুনছি যে অস্ত্রগুলো নকল। আগে যদি জানতাম অস্ত্রগুলো নকল, তাহলে আমরা এত আতঙ্কগ্রস্ত হতাম না।’
কথাগুলো বলছিলেন গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে রূপালী ব্যাংক পিএলসির জিনজিরা শাখায় ডাকাতির চেষ্টকালে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা জিম্মি অবস্থায় থাকা ব্যাংকের গ্রাহক বাবুল খান। পেশায় ঠিকাদার বাবুলের বাড়ি উপজেলার চুনকুটিয়া এলাকায়।
গতকাল বেলা দুইটার দিকে চুনকুটিয়া পাকাপুল এলাকায় রূপালী ব্যাংকের জিনজিরা শাখায় কিশোর–তরুণসহ তিনজন হানা দেন। একপর্যায়ে তাঁরা ব্যাংকে কর্মরত ১০ কর্মকর্তা ও ৬ গ্রাহককে ‘খেলনা পিস্তলের’ মুখে জিম্মি করেন এবং ব্যাংকের কাউন্টার থেকে ১৮ লাখ টাকা লুট করেন। খবর পেয়ে ভবনটি ঘিরে ফেলেন স্থানীয় লোকজন ও যৌথ বাহিনী। সাড়ে তিন ঘণ্টা পর তিনটি ‘খেলনা’ পিস্তলসহ আত্মসমর্পণে বাধ্য হন ওই তিনজন। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হেফাজতে নিয়ে তাঁদের কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় নিয়ে যায়।
ডাকাতির ঘটনার বর্ণনা দিয়ে গ্রাহক বাবুল খান বলেন, ব্যবসার টাকা জমা দিতে বেলা দুইটার দিকে তিনি রূপালী ব্যাংকের জিনজিরা শাখায় যান এবং ক্যাশ কাউন্টারে এক কর্মকর্তার কাছে টাকা জমা দেন। তিনি যখন টাকা গুনছিলেন, তখন মাস্ক ও চশমা পরে তিনজন ব্যাংকে ঢোকেন। তাঁরা সঙ্গে করে একটি তালা নিয়ে এসেছিলেন। ঢোকার পরপরই তাঁরা ওই তালা দিয়ে ব্যাংকে ঢোকার দরজা বন্ধ করে দেন এবং ব্যাংকের দুজন নিরাপত্তাপ্রহরীকে পিস্তলের ভয় দেখিয়ে মেঝেতে বসিয়ে রাখেন। ব্যাংকে তখন কর্মকর্তা-কর্মচারী, গ্রাহকসহ প্রায় ১৭ জন ছিলেন। তাঁরা সবাইকে পিস্তলের ভয় দেখিয়ে এক জায়গায় নিয়ে মাথা নিচের দিকে উপুড় করে বসতে বলেন।
বাবুল খান বলেন, ওই তিনজন সবার মোবাইল নিয়ে নেন। কারও মোবাইলে কল এলে তাঁরাই (তিনজন) রিসিভ করছিলেন। পরে তাঁরা ব্যাংকের সিসিটিভি ক্যামেরা ভাঙচুর করে তার ছিঁড়ে ফেলেন। এ ছাড়া কিছু আসবাব ভাঙচুর করেন। এতে সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে দুজন পিস্তল তাক করে সবাইকে পাহারা দেন। বাকি একজন ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ব্যাগে ভরছিল। যখন তাঁরা টের পান বাইরে অনেক মানুষ জড়ো হয়েছেন, তাঁদের বের হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেছে, তখন তাঁরা ব্যাংকের পেছনের দিকে থাকা লোহার গ্রিল ভেঙে বের হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু গ্রিল ভাঙতে পারেননি। তখন তাঁরা ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসা করেন, মূল দরজার বাইরে বের হওয়ার অন্য কোনো পথ আছে কি না। ব্যাংকের কর্মকর্তারা বের হওয়ার পথ শুধু একটি বলে জানান। এরপরও তাঁরা বের হওয়ার অনেক চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ব্যর্থ হন।
ঠিকাদার বাবুল খান আরও বলেন, ‘তাঁরা তিনজন আমাদের কাউকে মারধর করেননি। তেমন ক্ষিপ্তও ছিলেন না। তাঁরা আমাদের বলেছেন, “এই টাকা সরকারের। কিন্তু আপনারা কোনো চালাকি করলে আপনাদের জীবন যাবে।” তখন অনেকে কালেমা পড়া শুরু করেছিলেন। ওই সময় ভয়ে ব্যাংকের এক নারী কর্মচারী অনেক কান্নাকাটি করছিলেন। তাঁরা ওই নারীকে ব্যাগ থেকে এক লাখ টাকা দিয়ে বলেন, “আপনি বেশি আতঙ্কিত হয়েছেন। এই টাকা আপনি রাখেন, এটা আপনার জন্য।” এ ছাড়া তাঁরা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে নাশতা, কোমল পানীয়, সিগারেট ও পানি আনিয়েছিলেন। ওই কোমল পানীয় তাঁরা গ্লাসে ঢেলে সবাইকে পান করতে দিয়েছিলেন। নাশতাও খেতে দিয়েছিলেন। আর সিগারেট তাঁরা নিজেদের জন্য এনেছিলেন। পরে তাঁরা যে টাকা নিয়েছিলেন, সেই টাকা থেকে এক লাখ টাকা ব্যাংকের ক্যামেরা ও আসবাব ভাঙচুরের ক্ষতিপূরণ বাবদ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দেন।’
বাবুল খান প্রথম আলোকে বলেন, বিকেলে সেনাবাহিনীর আসার খবর পেয়ে তিনজন আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এর আগে সবাই চাঙা ছিলেন। এরপর নিচে বসা ব্যক্তিদের কেউ কেউ উঠে চেয়ারে, সোফায় বসেন। তখন তাঁরা স্বস্তি ফিরে পান। একপর্যায়ে ওই তিনজন সিগারেটের ছাই রাখার অ্যাশট্রের মধ্যে মোবাইল ঢুকিয়ে কিছু ছেঁড়া তার যুক্ত করে স্কচটেপ পেঁচিয়ে বোমাসদৃশ বস্তু বানান। ওঁরা তিনজন যখন বের হচ্ছিলেন, তখন ব্যাংকের কর্মকর্তাকে বলেন, ‘আমরা বের হওয়ার পর যদি কোনো চালাকি করেন, তাহলে আমাদের মুঠোফোন থেকে একটি কল দেওয়ার পরপরই এ বোমার বিস্ফোরণ ঘটবে।’ তখন আর কেউ বেঁচে ফিরতে পারবেন না। এতে তাঁরা ভয় পেয়ে যান। পরে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় তাঁরা অক্ষত অবস্থায় ব্যাংক থেকে বের হন।