গোখাদ্য
চার বছরে দাম বেড়েছে দ্বিগুণ
তারাগঞ্জে গত চার বছরে গোখাদ্যের দাম কয়েক দফা বেড়েছে। এতে অনেকে খামার বন্ধ করে দিয়েছেন। এ সময় চালের খুদের দাম বেশি বেড়েছে।
একসময় গরুর দুধ বিক্রির টাকা দিয়ে সংসারের খরচ চালিয়ে কিছু টাকা সঞ্চয় করতেন রতন মিয়া। এক বছর আগেও তাঁর খামারে চারটি ফ্রিজিয়ান জাতের গাভি ছিল। আজ তাঁর খামার শূন্য। কারণ, গোখাদ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় দুধ বিক্রি করে যা আয় করতেন তা দিয়ে সংসারের চালাতে তাঁর খুব কষ্ট হতো। গরু পালন করে মাসের পর মাস তিনি লোকসান দিচ্ছিলেন। এ অবস্থায় তিনি গরুগুলো বিক্রি করে দিয়েছেন।
রতন মিয়ার বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী গ্রামে। গোখাদ্যের দাম দফায় দফায় বাড়ায় রতন মিয়ার মতো ২৫ জন তাঁদের গরুর খামার বন্ধ করে দিয়েছেন।
গোখাদ্যের দাম বাড়ার বিষয়ে উপজেলার অন্তত ১৫ জন গরুর খামারি বলেন, খড় ও ঘাসের পাশাপাশি গরু-ছাগলকে ভুসি, চালের খুদ, ধানের কুঁড়া এবং বিভিন্ন কোম্পানির তৈরি কৃত্রিম ফিড (দানাদার খাদ্য) খাওয়ানো হয়। অন্তত সাতজন গোখাদ্য ব্যবসায়ী বলেন, গত তিন মাসে প্রতি কেজি গমের ভুসিতে ৬ টাকা, বুটের খোসায় ১০, চালের খুদে ৬ ও দানাদার ফিডে ৭ টাকা বেড়েছে।
বিভিন্ন হাটবাজার ঘুরে ক্রেতা ও বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিন মাস আগেও ভুসি প্রতি বস্তা (৩৭ কেজি) বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৭০০ টাকা, বুটের খোসা প্রতি বস্তা (২৫ কেজি) ১ হাজার ৩০০, দানাদার ফিড প্রতি বস্তা (২৫) ১ হাজার ২২৫ ও খুদ প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) ১ হাজার ৪৫০ টাকা। সে হিসাবে প্রতি কেজি গমের ভুসির দাম ৪৬ টাকা, বুটের খোসা ৫২, চালের খুদ ২৯ ও দানাদার ফিডের দাম ৪৯ টাকা ছিল। কিন্তু প্রতি কেজি গমের ভুসি ৫২ টাকা, বুটের খোসা ৬২, চালের খুদ ৩৮ ও দানাদার ফিড ৫৫ টাকা হয়েছে। এসব গোখাদ্যের দাম বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত তিন মাসে প্রতি কেজি গমের ভুসিতে ৬ টাকা, বুটের খোসায় ১০, চালের খুদে ৬ ও দানাদার ফিডে ৭ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে।
ইকরচালী বাজারের গোখাদ্য ব্যবসায়ী এরশাদ আলী বলেন, ‘মানুষ এখন আগের তুলনায় গরুর জন্য দানাদার ফিড, ভুসি ও খুদ কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। গত পাঁচ বছরে গোখাদ্যের দাম প্রতিষ্ঠানগুলো কয়েক গুণ বাড়িয়েছে। ২০২০ সালে যে ভুসি ৩২ টাকা কেজি বিক্রি করেছি তা এখন ৫২ টাকা, ৩৮ টাকার বুটের খোসা ৬২, ১৬ টাকার চালের খুদ ৩৮ এবং ৩২ টাকার দানাদার ফিড ৫৫ টাকায় উঠেছে। গোখাদ্যের দাম বাড়ায় অনেকে খামার বন্ধ করে দিয়েছেন। তাঁদের কাছ থেকে বকেয়া ওঠানো কঠিন হয়ে গেছে।’
হাজিপাড়া গ্রামের সাহিবার রহমান দিনমজুরি কাজের পাশাপাশি দুটি গাভি পালন করেন। সেই গাভির দুধ বিক্রি করে এখন আর তাঁর লাভ হচ্ছে না জানিয়ে বলেন, ‘ভাই আগের দিন শ্যাষ হয়া গেইছে। সংসারে খরচ, গরুর খাবারে খরচ বাড়ছে। কিন্তু গরুর দুধের দাম বাড়ে নাই। বাজারোত মাংসের দাম, গরু বেচার গেইলে দাম নাই। গরু দুইটাক খিলি এ্যালা লোকসান হওছে (হয়েছে)। ওই জন্যে সিদ্ধান্ত নিছু, সামনে হাটোত বিক্রি করি দেউম (দেব)।’
পোদ্দাপাড়া গ্রামের খামারি হামিদুল ইসলাম বলেন, ‘খড় থেকে শুরু করে গোখাদ্যের যে হারে দাম বাড়ছে, তাতে আর কুলাতে পারছি না। ইতিমধ্যে খামারের অর্ধেক গরু বিক্রি করেছি। বাকিগুলো বিক্রি করে দেব ভাবছি। লোকসান দিয়ে তো আর খামার করতে পারি না।’
তারাগঞ্জ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়শনের সভাপতি এমদাদুল হক বলেন, বর্তমানে খামারিদের অবস্থা নাভিশ্বাস। খামারিদের বাঁচাতে হলে দুধের দাম বাড়ানো, গোখাদ্যে ভর্তুকি প্রদান, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে খামার পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা বৃদ্ধি, নিম্নমানের গুঁড়া দুধ আমদানি বন্ধ করা, গোখাদ্যের সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের বিচারের আওতায় আনা ও ভেজাল খাদ্য রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।
তারাগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নে ছোট–বড় মিলে ১৩৭টি গরুর খামার রয়েছে। এ ছাড়াও কৃষকদের বাড়িতে প্রায় ৯০ হাজার গরু রয়েছে।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ফজলুল করিম বলেন, ‘গোখাদ্যের দাম বাড়ায় ছোট ও মাঝারি খামারিরা বিপাকে রয়েছেন। তাঁদের আমরা দানাদার খাবারের বিকল্প গড়ে তুলতে পরামর্শ দিচ্ছি। গাভিকে খড়ের পাশাপাশি কাঁচা ঘাস বেশি খাওয়াতে হবে। সমবায়ের ভিত্তিতে খামার করলে খরচ কমবে এবং খামারিরা লাভবান হবেন।’