খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন ৩ হাজার রোহিঙ্গার

কক্সবাজারের উখিয়া লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরে অগ্নিকাণ্ডে ঘর পুড়ে গেছে। ত্রিপলের ছাউনি টেনে আপাতত মাথা গোঁজার ঠাঁই বানানোর চেষ্টা চলছে। আজ বুধবার সকালেছবি: প্রথম আলো

পাহাড়ের ঢালুতে খোলা মাঠ। আশপাশে কিছু গাছপালা। কনকনে শীত ও ঘন কুয়াশায় খোলা মাঠে রাত কাটালেন কয়েক শ রোহিঙ্গা। অগ্নিকাণ্ডে তাঁদের ঘরের আসবাব, বাসনকোসন, কাপড় ও টাকা পুড়ে গেছে। অনেক পরিবারে রান্নাও হয়নি। দোকান থেকে শুকনা খাবার কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই অনেকের।

আজ বুধবার সকালে কক্সবাজারের উখিয়ার লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-১) ডি ব্লকে গিয়ে এমন অবস্থা দেখা যায়। দুপুরের দিকে সেখানকার বাসিন্দারা ধ্বংসস্তূপে নতুন করে ঘরবাড়ি তোলার চেষ্টা চালাচ্ছেন। গাছের খুঁটির সঙ্গে ত্রিপলের ছাউনি দিয়ে কোনোমতে মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরি করছেন।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে আগুনে ৬১৯টি ঘর পুড়ে ভস্মীভূত হয়। ঘরগুলো ত্রিপলের ছাউনি দিয়ে তৈরি। আগুনে পুড়ে মারা গেছেন দুজন রোহিঙ্গা। তাঁরা হলেন আশ্রয়শিবিরের সি ব্লকের রোহিঙ্গা আবুল খায়ের (৬০) ও একই ব্লকের মোস্তাফিজুর রহমানের ছেলে বোরহান উদ্দিন (৬)।

আগুনে রোহিঙ্গা নারী কুলসুমা বেগমের ঘর পুড়ে গেছে। তিনি তিন সন্তান নিয়ে আশ্রয় নেন পাশের খোলা মাঠে। অন্যের কাছ থেকে চেয়ে আনা পুরোনো কাপড়ে শিশুদের শরীর ঢেকে শীতের একটি রাত পার করেন। এখন মাথা গোঁজার স্থায়ী ঠিকানা নিয়ে চিন্তিত কুলসুমা বেগম (৪০) বলেন, কনকনে শীতে গোসল, টয়লেট নিয়ে নারীদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। আগুনে সবকটি গোসলখানা, ল্যাট্রিন পুড়ে গেছে। নলকূপ অচল থাকায় দূর থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে।

গৃহহীন আরেক রোহিঙ্গা সাহাব উদ্দিন (৪৭) বলেন, আশ্রয়শিবিরে প্রায় প্রতিবছর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। সব অগ্নিকাণ্ড রাতে ঘটলেও এবার দিনদুপুরে ঘটনা ঘটেছে। বিপদ থেকে রোহিঙ্গাদের উদ্ধার করার চাইতে কিছু মানুষকে দেখা গেল ঘরবাড়ি থেকে মালামাল-সম্পদ লুট করতে। দিনের বেলায় আগুন লাগার নেপথ্যে অন্য কোনো রহস্য আছে কি না তদন্ত করা দরকার।

আগুনে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে অনেক রোহিঙ্গা পরিবার। আজ বুধবার সকালে কক্সবাজারের উখিয়া লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরে
ছবি: প্রথম আলো

এই আশ্রয়শিবিরে অন্তত ৫০ হাজার রোহিঙ্গার বসবাস। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার সামছু-দ্দৌজা নয়ন প্রথম আলোকে বলেন, গতকালের দুই ঘণ্টার অগ্নিকাণ্ডে আশ্রয়শিবিরে ডি ও সি ব্লকের ৬১৯টি রোহিঙ্গা বসতি (ঘর) পুড়ে গেছে। তাতে ৩ হাজার ২০০ জন রোহিঙ্গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আগুনে পুড়ে মারা গেছেন দুজন। গৃহহীনদের জন্য দুপুর ও রাতে রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হবে। অধিকাংশ রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে থাকা আত্মীয়স্বজনের ঘরে অবস্থান করছেন। ধ্বংসস্তূপের ওপর স্থায়ী ঘর নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে। নকশার কাজ শেষ হলে ঘর নির্মাণের কাজ শুরু করা হবে। তত দিন ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের খাবার সরবরাহসহ মানবিক সেবা দেওয়া হবে।

রোহিঙ্গা নেতারা জানান, গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আশ্রয়শিবিরের ডি ব্লকের একজন রোহিঙ্গার রান্নাঘরের চুল্লি থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। মুহূর্তে তা আশ্রয়শিবিরের অন্যান্য ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। সেনাবাহিনী, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), ফায়ার সার্ভিস ও স্বেচ্ছাসেবীরা বেলা আড়াইটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন । ততক্ষণে ৬১৯ ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

আগুনে পুড়ে নিহত আবুল খায়েরের ভাতিজা মো. মুজিব উল্লাহ (৪০) বলেন, আগুন যখন দাউ দাউ করে জ্বলছিল, তখন আবুল খায়ের ঘরের ভেতরে ঘুমিয়ে ছিলেন। নানাভাবে চেষ্টা করেও তাঁকে ঘর থেকে বের করা সম্ভব হয়নি।

আগুনের সূত্রপাত কীভাবে তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কক্সবাজার ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক তানহারুল ইসলাম বলেন, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট অথবা রান্নার কাজে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) ও অতিরিক্ত সচিব মিজানুর রহমান বলেন, মঙ্গলবারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি। তবে ক্যাম্প ইনচার্জের মাধ্যমে আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধান করা হচ্ছে।

সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ২০২১ সালের ২২ মার্চ উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরে। আগুনে বালুখালী আশ্রয়শিবিরের পাঁচটি ক্যাম্প ১০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বসতি পুড়ে ছাই হয়েছিল।

৬ বছরে ২১০টি অগ্নিকাণ্ড
পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতারা জানায়, গত ১ জুন উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের তানজিমারখোলা আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-১৩) অগ্নিকাণ্ডে ১৭৫টি বসতিসহ অন্তত ২৩০টি অবকাঠামো ভস্মীভূত হয়েছিল। তাতে অন্তত ১ হাজার ২০০ রোহিঙ্গা গৃহহীন হয়ে পড়েছিল। ২০২৩ সালের ২৪ মে বালুখালী আশ্রয়শিবিরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তিন শতাধিক রোহিঙ্গা বসতি পুড়ে ছাই হয়।

সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ২০২১ সালের ২২ মার্চ উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরে। আগুনে বালুখালী আশ্রয়শিবিরের পাঁচটি ক্যাম্প ১০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বসতি পুড়ে ছাই হয়েছিল। তখন ৬ শিশুসহ অন্তত ১৪ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়। গৃহহীন হয়ে পড়ে ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা।

পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও রোহিঙ্গা নেতাদের দেওয়া তথ্যমতে, গত ছয় বছরে আশ্রয়শিবিরে ছোট–বড় মিলে অন্তত ২১০টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত রান্নাঘরের গ্যাস সিলিন্ডার থেকে। তবে নাকশতার অন্তত ২৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রোহিঙ্গা ঘর পুড়েছিল ৫০০ থেকে ১০ হাজার।

বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। গত সাত বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।