নলেন গুড়ের প্যাড়া সন্দেশ
শীত এসেছে। খেজুর রসের তৈরি গুড় ছাড়া এই শীতকালটা যেন জমেই না। আর তা যদি হয় নলেন গুড়, তাহলে তো কথাই নেই। এ গুড়ের তৈরি পিঠাপুলি ও পায়েসের নাম শুনলেই জিবে পানি এসে যায়। নলেন গুড়, খাঁটি দুধের উৎকৃষ্ট ছানা আর চিনি—এই তিনের সমন্বয়ে তৈরি হয় ‘নলেন গুড়ের প্যাড়া সন্দেশ’।
৪০ বছর ধরে খেজুরগাছ কাটছেন যশোরের অভয়নগর উপজেলার অভয়নগর গ্রামের গাছি সাহাদাত গাজী (৬৫)। তিনি এবার ১২০টি খেজুরগাছ কাটছেন। তাঁর ভাষায়, মৌসুমের শুরুতে খেজুরগাছ চেঁছে নলি পোঁতা হয়। নলি পোঁতার পর প্রথমবার সংগ্রহ করা রস থেকে তৈরি গুড়কে ‘নলেন গুড়’ বলে।
সংগ্রহ করে রাখা এই নলেন গুড় দিয়ে প্রায় সারা বছর তৈরি করা হয় প্যাড়া সন্দেশ। তবে শীতকালে এর কদর বেশি। ‘যশোরের যশ, খেজুরের রস’। আবহমানকাল ধরে চলে আসা এই প্রবাদ যশোরের ক্ষেত্রে আজও প্রাসঙ্গিক। যশোরের ঐতিহ্য নলেন গুড়ের প্যাড়া সন্দেশ।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ সতীশচন্দ্র মিত্রের যশোর-খুলনার ইতিহাস গ্রন্থে (১৯১৪ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত) যশোরের খেজুরের গুড়ের উল্লেখ আছে। ওই বর্ণনা অনুযায়ী, ১৯০০-০১ সালে পূর্ববঙ্গে খেজুরের গুড় তৈরি হয়েছে প্রায় ২২ লাখ মণ, যা প্রায় ৮২ হাজার টনের সমান।
যশোরের নলেন গুড়ের প্যাড়া সন্দেশের ঐতিহ্য ২০০ বছরের বেশি সময়ের। প্যারা বা অংশ থেকে প্যাড়া নামটি এসেছে। নলেন গুড় দিয়ে তৈরি বৃত্তাকার চ্যাপটা আকৃতির সন্দেশের দুটি অংশ জোড়া দিয়ে এটি তৈরি করা হয়। এ জন্য এর নাম হয়েছে নলেন গুড়ের প্যাড়া সন্দেশ। বছরের মাত্র তিন মাস—পৌষ, মাঘ ও ফাল্গুনে এই প্যাড়া সন্দেশ পাওয়া যায়।
ময়রারা জানান, প্রথমে দুধ জ্বাল দিয়ে ছানা তৈরি করা হয়। এরপর ছানা একটি গামছায় পেঁচিয়ে গামছাটি কিছুক্ষণ ঝুলিয়ে রেখে ছানা পানিশূন্য করা হয়। উনুনের ওপর রাখা লোহার কড়াইয় একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে ছানা, নলেন গুড় ও চিনি মিশিয়ে ৩০ মিনিটের মতো তাপ দিতে হয়। উনুন থেকে কড়াই নামিয়ে সন্দেশ ঠান্ডা করা হয়। কড়াই থেকে সন্দেশ তুলে গুটি গুটি করে টেবিলের ওপর রাখা হয়। এরপর গুটিগুলো পেটানো হয়। শেষে দুটি গুটি জোড়া লাগিয়ে বৃত্তাকার চ্যাপটা আকৃতির প্যাড়া সন্দেশ তৈরি করা হয়। প্যাড়া সন্দেশের দানা মোটা ও রং কিছুটা লালচে হয়।
বাঘারপাড়া উপজেলার দোহাকুলা গ্রামের গাছি হারুন মোল্যা (৬৮) এবার ১১৩টি গাছ কাটছেন। গাছ কাটার ফাঁকে তিনি জানান, এ বছর ৪০০ টাকা কেজি দরে নলেন গুড়ের পাটালি বিক্রি করছেন তিনি।
যশোর শহরে ১৩২ বছরের মিষ্টি তৈরির দোকান ‘জলযোগ’। শুরু থেকে প্যাড়া সন্দেশ তৈরি করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। মালিক সাধন কুমার বিশ্বাস বলেন, শীতের শুরুতে নলেন গুড় পাওয়া যায়। এই নলেন গুড় দিয়ে তৈরি প্যাড়া সন্দেশের খুব চাহিদা থাকে। উৎসব-পার্বণে উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। এখন প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ কেজি প্যাড়া সন্দেশ তৈরি করছেন। অর্ডার থাকলে আরও বেশি হয়। প্রতি কেজি প্যাড়া সন্দেশ বিক্রি করছেন ৪৮০ টাকায়।
যশোর শহরে প্রায় ৮৫ বছর ধরে নলেন গুড়ের প্যাড়া সন্দেশ তৈরি করছে দেবু সুইটস। এর মালিক চিত্তরঞ্জন অধিকারী বলেন, প্যাড়া সন্দেশের উপাদান দুধ, নলেন গুড় ও চিনি। অনুপাত হচ্ছে, ১০ কেজি দুধের ছানার সঙ্গে ২ কেজি চিনি ও ১ কেজি নলেন গুড়। অন্য সন্দেশের চেয়ে এর বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ আলাদা। পৌষ, মাঘ ও ফাল্গুন মাসে এর বেশ চাহিদা থাকে। এ সময় এর স্বাদও থাকে অন্য রকম। অন্য সময়ও প্যাড়া সন্দেশ হয়, তবে স্বাদ এই সময়ের মতো থাকে না।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, যশোর সূত্র বলছে, জেলার আট উপজেলায় মোট ২৩ লাখ ৯২ হাজার ৩৮৩টি খেজুরগাছ আছে। এর মধ্যে রস হয় এমন গাছ রয়েছে ৩ লাখ ১২ হাজার ৬০৬টি। সবচেয়ে বেশি খেজুরগাছ রয়েছে যশোর সদর, মনিরামপুর, অভয়নগর, চৌগাছা ও বাঘারপাড়া উপজেলায়। একটি গাছ থেকে মৌসুমে গড়ে ১৫০ লিটার রস পাওয়া যায়। ওই রস জ্বালিয়ে প্রায় ১৫ কেজি গুড় হয়। জেলায় বছরে গড়ে পাঁচ হাজার মেট্রিক টন গুড়-পাটালি উৎপাদিত হয়।
শিক্ষাবিদ আমিরুল আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, সন্দেশ সারা দেশেই তৈরি হয়। বিভিন্ন জায়গায় সন্দেশের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য রয়েছে। নলেন গুড়ের প্যাড়া সন্দেশের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আগে খাঁটি নলেন গুড় দিয়েই প্যাড়া সন্দেশ তৈরি হতো। কিন্তু পরে চিনির দাম কম থাকায় গুড়ের সঙ্গে চিনি মেশানো শুরু হয়। নলেন গুড়ের প্যাড়া সন্দেশের ঐতিহ্য ধরে রাখতে হলে আগে ভেজাল বন্ধ করতে হবে।