‘মোর বাবায় বিজয়ের লাল সূর্য দেইখ্যা মরতে পারল না’

ইলিয়াসের মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া কয়েকজন শিক্ষার্থী। আজ শুক্রবার বরিশালের গৌরনদী উপজেলার চাঁদশীতেছবি: প্রথম আলো

‘মোর বাবায় বিজয়ের লাল সূর্য দেইখ্যা মরতে পারল না। যদি জানতে পারত, তাগো সংগ্রাম জিতছে, হ্যালে আনন্দ পাইত, বাবার আত্মা শান্তি পাইত,’ এভাবেই বিলাপ করছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত ইলিয়াস খানের মা রেখা বেগম (৫৫)। আজ শুক্রবার দুপুরে ইলিয়াস খানের বাড়িতে গিয়ে এমন পরিস্থিতি দেখা যায়।

নিহত ইলিয়াস খানের (২৫) বাড়ি বরিশালের গৌরনদী উপজেলার চাঁদশী ইউনিয়নের পশ্চিম শাওড়া গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মো. ফারুক খান। ইলিয়াস খান ছাত্রদল করতেন। ৪ আগস্ট ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে কর্মসূচিতে অংশ নেন তিনি। মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ চৌরাস্তা এলাকায় কর্মসূচি চলাকালে তাঁর মাথায় গুলি লাগে। পরে তাঁকে উদ্ধার করে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আজ শুক্রবার সকাল ৮টায় সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

রেখা বেগম বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘আইজগো মোর বাড়িতে কত বাবায় আইছে, হ্যাগো লগে মোর বাবায় নাই। হে আল্লাহ ক্যান এমন অইল।’

শুক্রবার দুপুরে ইলিয়াস খানের বাড়িতে দেখা যায় শত শত নারী-পুরুষ, শিশু, আত্মীয়স্বজনের ভিড়। সবাই কান্না করছেন। ইলিয়াসের মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া কয়েকজন শিক্ষার্থী। বাড়ির পাশেই তৈরি করা হয়েছে ইলিয়াস খানের কবর।

স্থানীয় লোকজন ও গ্রামবাসী জানান, ইলিয়াস খান লেখাপড়া শেষ করে চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি গৌরনদী উপজেলা ছাত্রদলের সদস্য ছিলেন। স্থানীয় ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কারণে ২৫ জুলাই চাঁদশী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও চাঁদশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও চেয়ারম্যান সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁর বাহিনী দিয়ে তাঁকে ধরে নিয়ে একটি কক্ষে আটকে রেখে নির্মমভাবে নির্যাতন করে এলাকা ছাড়তে নির্দেশ দেন। প্রাণ বাঁচাতে ২৮ জুলাই ইলিয়াস খান তাঁর বন্ধু নয়ন ইসলামের কাছে ঢাকা মোহাম্মদপুর চলে যান এবং সেখানে গিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেন।

ইলিয়াস খানের বড় ভাই মো.মহসীন খান কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার ভাই ঢাকায় গিয়েও আন্দোলনে যোগ দেয়। সর্বশেষ ৩ আগস্ট ফোনে আমাকে বলে, “ভাই, আমি আন্দোলনে আছি, যদি মারা যাই, মা-বাবাকে দেখো রেখো। আর যদি বেঁচে থাকি, তাহলে দেখা হবে। আমার শত শত ভাই প্রাণ দিচ্ছে, আমি একা বেঁচে থেকে কী হবে, তুমি দোয়া কোরো, আমরা যেন দেশ স্বাধীন করতে পারি।”’

মহসীন খান বলেন, ৪ আগস্ট বিকেল ৫টার দিকে মোহাম্মদপুর চৌরাস্তায় আন্দোলনে গিয়ে ইলিয়াসের মাথার ডান পাশে গুলি লেগে বাঁ পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। এতে তাঁর একটি চোখ বের হয়ে গেছে। আহত অবস্থায় সহযোদ্ধারা ইলিয়াসকে হাসপাতালে ভর্তি করেন। ভর্তির পর থেকে ইলিয়াস অচেতন অবস্থায় ছিলেন। ছয় দিন পর আজ শুক্রবার সকাল ৮টা তিনি হাসপাতালে মারা যান।

ইলিয়াস খানের বাবা মো. ফারুক খান (৫৮) বলেন, ‘মোর পোলায় রাজনীতির সংগ্রাম করছে দেইখ্যা আমলীগের নেতারা মোর পোলাডারে ধইরা নিয়া কী যে মারা মারছে। মোর বড় পোলার দোকান বন্ধ কইরা দিছে। দল করার অপরাধে ঋণ নিয়া চেয়ারম্যানরে চান্দা দিতে অইছে। আইজ সব ঠিক অইয়া গ্যাছে, মোর পোলাডা বাইচ্চা নাই।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী মো. বাবুল হোসেন, আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘যেই দেশপ্রেম ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের চেতনায় নতুন প্রজন্মের ছাত্ররা প্রাণ দিলেন, তাঁদের সেই স্বপ্নের দেশ গড়তে পারলে শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে। আমাদের আন্দোলনের সার্থক হবে। আমরা দেশবাসীর প্রতি শহীদদের কথা স্মরণ রেখে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আহ্বান জানাই।’