বাসার নিচে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত, এখন সোহেল মিয়ার সংসারের হাল ধরবে কে
নিজ চেষ্টায় মুঠোফোন মেরামতের কাজ শিখেছিলেন সোহেল মিয়া। ঢাকায় ছিল তাঁর মুঠোফোন যন্ত্রাংশ বিক্রি ও মেরামতের দোকান। তাঁর আয়েই সংসার চলেছে; বড় হয়েছে তাঁর ভাইবোনেরা। বিয়ে করে আলাদা সংসার হয়েছে সোহেলের। তবে বৃদ্ধ মা–বাবা ও ছোট ভাইয়ের সংসারে সব সময় সহায়তা করেছেন।
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন সোহেল মিয়া (৩৫)। তাঁর এই অকালমৃত্যুতে পরিবারের সবাই অকূল পাথারে পড়েছেন। তাঁদের এখন একটাই চিন্তা, সংসার চলবে কীভাবে?
ঢাকার শনির আখড়া এলাকায় নিজ বাসার সামনে গত ২০ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন সোহেল মিয়া। তিনি ময়মনসিংহের ত্রিশালের মঠবাড়ী ইউনিয়নের অলহরী দুর্গাপুর গ্রামের সুরুজ মিয়া ও হাসনা আরা দম্পতির ছেলে। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে বড় ছিলেন সোহেল মিয়া। ২২ জুলাই তাঁকে গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়।
স্ত্রী আয়শা আক্তার ও সাড়ে তিন বছরের ছেলে হযরতকে নিয়ে ঢাকার শনির আখড়া এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন সোহেল মিয়া। ওই এলাকায় আরএস টাওয়ার মার্কেটে সোহেল টেলিকম নামে একটি দোকান ছিল তাঁর। মুঠোফোনের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ বিক্রি ও মেরামতের কাজ করতেন সোহেল। ছোট ভাই জুয়েল মিয়াও তাঁর দোকানে কাজ করতেন। মা–বাবা ও ছোট ভাই জুয়েল মিয়া থাকেন রায়েরবাগের মেরাজনগর এলাকায়।
জুয়েল মিয়া বলেন, ‘শনির আখড়া এলাকায় বাসার সামনেই গুলিবিদ্ধ হয় ভাই (সোহেল)। ওই দিন (২০ আগস্ট) বেলা ১১টার দিকে ভাইয়া আমাদের বাসায় আসেন। মাকে বলেছিলেন, “মার্কেট বন্ধ। বাজারসদাই যা লাগে কিনে দিয়ে যাচ্ছি।” কাঁঠাল, আম নিয়ে এসেছিলেন। পরে সামনের দোকান থেকে এক বস্তা চাল কিনে দিয়ে যান। মাকে তিনি বলে যান, “দেশের অবস্থা ভালো না। যা লাগে যেন জানায়।” বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তিনি বাসা থেকে চলে যান। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে ভাই বাসার নিচে নেমে গুলিবিদ্ধ হন। পরে আমরা খবর পেয়ে ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে লাশ পাই।’
জুয়েল মিয়া আরও বলেন, ‘ভাইয়ের উপার্জনের টাকায় আমি ও দুই বোন বড় হয়েছি। বাবা আগে থেকেই তেমন কিছু করতেন না। তিনিই পুরো পরিবার চালাতেন। আমি ভাইয়ের দোকানে কাজ করতাম। এখন কোনো উপায় না পেয়ে রিকশা চালানো শুরু করেছি। দোকানের মালামাল ও মোটরসাইকেল বিক্রি করে সন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে গেছেন ভাবি (আয়শা)।’
সোহেল মিয়াকে নিজ গ্রামে দাফনের পর ঢাকায় ফিরে গেছেন তাঁর বাবা সুরুজ মিয়া। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সোহেল স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আমাদের বাসা থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে থাকত। আন্দোলনের সময় দোকান বন্ধ ছিল। ওই দিন (২০ জুলাই) আমাদের বাসায় আম, কাঁঠাল ও এক বস্তা চাল দিয়ে যায় সে। আমরা যেন বাসা থেকে বের না হই বলে যায়। কিন্তু বিকেলে আমার ছেলে বাসা থেকে রাস্তায় যেতেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে মারা যায়।’
সুরুজ মিয়া আরও বলেন, ‘চোখে কম দেখি। আমার ছেলেই সংসার দেখভাল করত। এই বৃদ্ধ বয়সে এখন জীবনে অন্ধকার নেমে এসেছে। আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। কিন্তু বিচার করবে কে?’
আমার ছেলেই সংসার দেখভাল করত। এই বৃদ্ধ বয়সে এখন জীবনে অন্ধকার নেমে এসেছে। আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। কিন্তু বিচার করবে কে?সুরুজ মিয়া, নিহত সোহেল মিয়ার বাবা
অলহরী দুর্গাপুর গ্রামে থাকেন নিহত সোহেল মিয়ার চাচা আবুল কালাম। তিনি সোহেলের কবর দেখাশোনা করছেন। শনিবার ওই গ্রামে গিয়ে কথা হয় আবুল কালামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সোহেল মা–বাবা ও ভাইবোনদের আগলে রাখত। চাচাদেরও খোঁজ রাখত। প্রায় ৩২ বছর চলে আমার ভাই তাঁর ভিটের দেড় শতক জমি বিক্রি করে ঢাকায় চলে যায়। সেখানে রিকশা চালিয়ে সন্তানদের বড় করেছে। পরে পুরো সংসারের হাল ধরেছিল সোহেল। একটি গুলি এসে সব তছনছ করে দিল।’