‘আমার বাপজানের ইতালি যাওয়া লাগত না, তোমরা ওরে ফিরাইয়া দাও’

ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে মারা যাওয়া সজল বৈরাগী (বাঁয়ে), সম্রাট ব্যাপারী (মাঝে) ও মামুন শেখ
ছবি: সংগৃহীত

অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের একটি নৌকাডুবিতে মাদারীপুরের তিন তরুণের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় নিখোঁজ আছে আরও বেশ কয়েকজন। মারা যাওয়া তরুণদের পরিবার আজ শনিবার সকালে প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার ভূমধ্যসাগরের তিউনিসিয়ার সীমানায় একটি নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। এতে বিভিন্ন দেশের আরও ছয়জন নিহত হয়েছেন। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ৫২ জনকে। নিখোঁজ রয়েছেন বেশ কয়েকজন।

মারা যাওয়া বাংলাদেশি ওই তিন তরুণ হলেন মাদারীপুর সদর উপজেলার পশ্চিম পাঁচখোলা এলাকার আলী আক্কাবরের ছেলে মো. সম্রাট ব্যাপারী (২৩), রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম স্বরমঙ্গল এলাকার ইউসুফ আলী শেখের ছেলে মামুন শেখ (২২) এবং একই ইউনিয়নের সেনদিয়া গ্রামের সুনীল বৈরাগীর ছেলে সজল বৈরাগী (২৪)।

ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে মারা যাওয়া মামুন শেখের বাড়িতে স্বজনদের আহাজারি। শুক্রবার বিকেলে মাদারীপুরের রাজৈরের পশ্চিম স্বরমঙ্গল এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

ওই তরুণদের স্বজন, স্থানীয় লোকজন ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, গত ১৪ জানুয়ারি উন্নত জীবনের আশায় বাড়ি ছাড়েন রাজৈরের মামুন শেখ ও সজল বৈরাগীসহ বেশ কয়েকজন তরুণ। আর সম্রাট ব্যাপারী আট মাস আগে স্থানীয় এক দালালের মাধ্যমে দেশ ছাড়েন, কিন্তু ইতালি ঢুকতে পারেননি। প্রথমে তাঁরা বাংলাদেশ থেকে দুবাই গিয়ে কয়েক দিন অবস্থান করেন। পরে সেখান থেকে নেওয়া হয় লিবিয়ার বেনগাজিতে। গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের প্রায় ৭০ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী নিয়ে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের বহন করা নৌকাটি ভূমধ্যসাগরের তিউনিসিয়ার সীমানায় প্রবেশ করলে নৌকাটির তলা ফেটে ডুবে যায়। খবর পেয়ে তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড ভূমধ্যসাগরে তল্লাশি চালিয়ে ৫২ জনকে জীবিত ও ৯ জনকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে।

দালাল চক্রটি মাদারীপুরের বিভিন্ন এলাকার তরুণদের ইতালি পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা নিয়েছেন।

গতকাল শুক্রবার মাদারীপুরের ওই তিন তরুণের বাবা-মায়ের কাছে খবর আসে, তাঁদের সন্তানেরা আর জীবিত নেই। এর পর থেকেই ওই তিন তরুণের পরিবারে চলছে মাতম।

মারা যাওয়া ওই তিন তরুণের স্বজনেরা জানান, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের রাঘদী ইউনিয়নের সুন্দরদী এলাকার মোশারফ কাজী দালাল চক্রের প্রধান। তাঁর সহযোগী একই এলাকার যুবরাজ কাজী ও মাদারীপুর সদর উপজেলার পাঁচখোলা এলাকার রাসেল খান। এই দালাল চক্রটি মাদারীপুরের বিভিন্ন এলাকার তরুণদের ইতালি পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা নিয়েছেন।
সজল বৈরাগীর বাবা সুনীল বৈরাগী বলেন, ‘আমার লগে বাপজানের কথা হইলো। বাপজন কইলো ওদের “গেম” (লিবিয়া থেকে ইতালির পথে যাত্রা) হইবে। কোনো ঝামেলা হইবে নাই। হঠাৎ শুনি আমার বাপজান আর নাই। আমার বাপজানের ইতালি যাওয়া লাগত না। তোমরা ওরে আমার কাছে ফিরাইয়া দাও।’

মামুনের বড় ভাই সজীব শেখ বলেন, ‘আমার ভাইকে যে নৌকায় ওঠায়, সেই নৌকায় ৭০ জনের মতো মানুষ ছিল। এটার ধারণক্ষমতা সর্বোচ্চ ৩০ জন হবে। বেশি মানুষকে একসঙ্গে নৌকায় ওঠানোয় নৌকার তলা ফেটে গেছে। দালালেরা বেশি লাভ করতে গিয়ে এই কাজ করছে। আমার ভাইকে মেরে ফেলছে দালাল মোশারফ। আমি তার বিচার চাই।’

সম্রাটের বড় ভাই আজগর ব্যাপারী বলেন, ‘দালাল আমাদের ফোন করে জানাইছে, ভাই মারা গেছে। দালাল নিজ দায়িত্বে লাশ দেশে এনে দেওয়ারও কথা জানাইছে। সে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথাও আমাদের বলছে। ভাই নাই, এটা মানতে পারছি না। অনেক কষ্ট কইরা ভাইরে ইতালি পাঠানোর চেষ্টা ছিল। সব শ্যাষ হইয়া গেল।’

এ বিষয়ে কথা বলতে দালাল চক্রের প্রধান গোপালগঞ্জের মোশারফ কাজীর মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তাঁর নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। খুদেবার্তা পাঠিয়েও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলাউল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে তিন তরুণ মারা যাওয়ার খবর আমরা শুনেছি। তবে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের পক্ষ থেকে আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত কোনো লিখিত অভিযোগ করেনি। তারপরেও এই দালাল চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমাদের অভিযান চলছে। তাদের বিষয় খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। উপযুক্ত প্রমাণ হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’