‘আমার আব্বারে কেরে গুলি করে মারছে’

কোটা আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষে নিহত আলী হোসেনের স্ত্রী খায়রুন্নেছা ও তিন মেয়ে। গত শনিবার নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার মোজাফরপুর (পশ্চিমপাড়া) গ্রামেছবি: প্রথম আলো

ঋণের টাকা পরিশোধ করতে বছরখানেক আগে ঢাকায় কাজের খোঁজে গিয়েছিলেন আলী হোসেন (৪৫)। সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী খায়রুন্নেছা (৩৫)। তাঁদের তিন মেয়ে গ্রামের বাড়িতে বৃদ্ধ দাদির কাছে ছিল।

ঢাকার উত্তরায় মুন্সি মার্কেট এলাকায় ভাড়া বাসায় ছিলেন আলী হোসেন ও খায়রুন্নেছা দম্পতি। রাস্তার পাশে বসে পান-সিগারেট বিক্রি করতেন আলী হোসেন। আর স্ত্রী খায়রুন্নেছা কাজ করতেন বাসাবাড়িতে। এভাবে কষ্ট করে প্রতি মাসে গ্রামে টাকা পাঠাতেন। ঋণ পরিশোধের পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণ চালিয়ে যেতেন তাঁরা। গত ১৮ জুলাই উত্তরা এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষে গুলিতে নিহত হন আলী হোসেন।

আলী হোসেনের বাড়ি নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার মোজাফরপুর ইউনিয়নের মোজাফরপুর (পশ্চিমপাড়া) গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের মৃত আসন আলীর ছেলে।
আলী হোসেনের পরিবারে রয়েছেন বৃদ্ধ মা বেদেনা আক্তার, স্ত্রী খায়রুন্নেছা, ছোট ভাই আবু বক্কর (২৮) ও তিন মেয়ে সাদিয়া আক্তার (১৪), মাহিবা আক্তার (৬) ও মারিয়া আক্তার (৩)। সহায়–সম্বল বলতে বসতভিটাটুকু ছাড়া আর কিছুই নেই। বৃদ্ধ মা প্রায়ই অসুস্থ থাকেন। ছোট ভাই আবু বক্করও শ্বাসকষ্টের রোগী।

পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্রামের বাজারে কাঁচামালের ব্যবসা করে কোনোরকমে সংসার চালাতেন আলী হোসেন। একপর্যায়ে লাখ টাকার মতো ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন তিনি। ঋণের টাকা পরিশোধের জন্য তিন মেয়েকে বৃদ্ধ মা ও ভাইয়ের কাছে রেখে বছরখানেক আগে সস্ত্রীক ঢাকায় চলে যান। সেখানে উত্তরা মুন্সি মার্কেট থেকে আজমপুর রেলস্টেশন এলাকায় কখনো রাস্তার পাশে বসে, কখনো–বা ঘুরে ঘুরে পান-সিগারেট বিক্রি করতেন তিনি।

গতকাল শনিবার দুপুরে মোজাফরপুর গ্রামে আলী হোসেনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, খায়রুন্নেছা ছোট সন্তানকে কোলে নিয়ে নির্বাক বসে রয়েছেন।

খায়রুন্নেছা জানান, ১৮ জুলাই সকাল আটটার দিকে পান্তাভাত খেয়ে পান–বিড়ি নিয়ে বের হন স্বামী আলী হোসেন। তিনিও মানুষের বাসায় কাজে চলে যান। দুপুরে বাসায় খেতে গিয়ে দেখেন স্বামী আসেননি। একপর্যায়ে স্বামীর খোঁজে বাসা থেকে বেরিয়ে যান খায়রুন্নেছা। যেখানে স্বামী নিয়মিত দোকান নিয়ে বসতেন সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, মালপত্র পাশের একজনের কাছে রেখে আলী হোসেন সামনে গিয়েছিলেন। কিন্তু দুই–তিন ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও ফিরে আসেননি। পরে স্থানীয় কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে আলী হোসেনের মরদেহ পড়ে থাকার খবর পান খায়রুন্নেছা।

খায়রুন্নেছা বলেন, ‘আমার সব শেষ হইয়া গেছে। আমার ছোট্ট ছোট্ট তিনটা মেয়ে নিয়া অহন কিবায় চলবাম কিছুই বুঝতাম পারতাছি না। কে দেখব আমরারে?’

আরও পড়ুন
আলী হোসেনকে গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়েছে
ছবি: প্রথম আলো

এ সময় খায়রুন্নেছার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বড় মেয়ে সাদিয়া আক্তার কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘আমার আব্বা খুবই ভালো মানুষ আছিল। আব্বাই ছিল আমাদের সব। আমরা তো কারও কোনো ক্ষতি করিনি। আমার সহজ–সরল আব্বারে কেরে গুলি করে মারছে? আমরা এর বিচার চাই। আল্লাহ যেন খুনিদের বিচার করেন।’

আলী হোসেনের বৃদ্ধ মা বলেন, ‘আমার ছেলের এমন মরণ হইব কোনো দিনও ভাবছি না। আল্লাহ আমার এমন সর্বনাশ কেরে করল? আমার অবুঝ নাতনিডিরে অহন কেডা দেখব?’

ভাইয়ের এমন মৃত্যুর পর সংসার কীভাবে চলবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন আবু বক্কর। তিনি বলেন, ‘আমার ভাই–ই ছিল আমরার সব। আমি অসুস্থ থাকায় ভারী কোনো কাজকাম করতে পারি না। ভাই সংসারের অভাব দূর ও ঋণের টেহা পরিশোধ করতে তার স্ত্রীকে লইয়া ঢাকায় গিয়েছিল। এখন তো আমরার সবকিছুই শেষ হয়ে গেল। এই হত্যার বিচার আমরা কার কাছে চাইব? ভাইকে তো আর ফিরে পাব না।’

মোজাফরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জাকির আলম ভূঁইয়া বলেন, ‘আলী হোসেনের মৃত্যুর ঘটনাটি আমাদের ব্যথিত করেছে। তিনি সাধারণ খেটে খাওয়া একজন মানুষ ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে পরিবারটি খুব অসহায় হয়ে পড়েছে। তাঁদের ১০ হাজার টাকা দিয়ে সহায়তা করেছি। আলী হোসেনের স্ত্রীকে বিধবা ভাতার কার্ড দেওয়া হবে। পরিবারটিকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে আরও সরকারি সহায়তা দরকার।’