ব্যর্থ হলে কারোরই অস্তিত্ব রাখবে না খুনি হাসিনা: সারজিস আলম

জুলাইয়ের অভ্যুত্থানে নিহত হওয়া ৫৫ জনের পরিবারকে অনুদান বিতরণ অনুষ্ঠানে সারজিস আলম। আজ শনিবার সকালে ময়মনসিংহ নগরের টাউন হলের তারেক স্মৃতি অডিটোরিয়ামেছবি: প্রথম আলো

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম বলেন, ‘খুনি হাসিনা ও তার দোসরেরা সব দিক দিয়ে চেষ্টা করছে, আমরা যেন সফল না হই। কোনোভাবে যদি আমরা ব্যর্থ হই, আমরা এখানে যারা রয়েছি, তাদের কারোরই অস্তিত্ব খুনি হাসিনা রাখবে না। ৫ আগস্ট এর আগে অনেক শহীদের পরিবার রয়েছে ঠিকমতো লাশ দাফন করতে দেওয়া হয় নাই। বাড়িতে থাকতে দেওয়া হয় নাই৷ হয়রানি করা হয়েছে। আবার যদি খুনি হাসিনার দোসররা আসে, তাহলে ওই কাজ করা হবে।’

আজ শনিবার সকালে ময়মনসিংহ নগরের টাউন হলের তারেক স্মৃতি অডিটোরিয়ামে জুলাইয়ের অভ্যুত্থানে নিহত হওয়া ৫৫ জনের পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা করে আর্থিক অনুদানের বিতরণ অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।

নগরের টাউন হলের তারেক স্মৃতি অডিটোরিয়ামে বেলা ১১টা ৯ মিনিটে জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ বীরদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

সারজিস আলম বলেন, ‘কালো শকুনদের খারাপ চক্রান্ত এখনো থামেনি।  আপনাদের দোয়ায় যদি বেঁচে থাকতে পারি তাহলে কোন শহীদ পরিবার ও আহতদের গায়ে একটি টোকাও লাগতে দিব না।  শহীদ পরিবার ও আহত ভাইদের কাউকে দুর্দশাগ্রস্ত জীবন যাপন করতে হবে না। এটি করতে হয়তো একটু সময় লাগবে। আমরা জীবনের বিনিময়ে সবটুকু দিয়ে সব সময় আপনাদের পাশে থাকব।’

সারজিস আলম আরও বলেন, ‘আমাদের সকলের দায়িত্ব যে স্বপ্ন নিয়ে, যে স্পিরিট নিয়ে এই অভ্যুত্থান হয়েছে সেটিকে রক্ষা করা। আমরা একদিকে যেমন সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করব, অপরদিকে প্রশাসনসহ সকল স্তরে সার্বিক কাজে সহযোগিতাও করব। প্রশাসনের যারা হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে জড়িত ছিল, ভিডিও ফুটেজ ও ছবি দেখে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এখন যারা প্রশাসনের দায়িত্ব পালন করছে এটি তাদের অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। কারণ তারা আজ এ জায়গায় বসেছেন এই অভ্যুত্থানের ফলে।’

অনুষ্ঠান শুরু করার আগে শহীদ পরিবারের সদস্যদের কাছে গিয়ে খোঁজ নেন সারজিস আলম। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ। এ সময় তিনি বলেন, ‘আহাজারি ও দুঃখ দেখে কেউ ঠিক থাকতে পারি না। দেশের প্রতিটি মানুষ এই শহীদ পরিবারের কাছে ঋণী।’

অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) মো. ইউসুফ আলী, পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি (ক্রাইম) মোহাম্মদ শরিফুর রহমান, জেলা প্রশাসক মুফিদুল আলম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) শামীম হোসেন, সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রতিনিধি চিকিৎসা কর্মকর্তা তুবাউল জান্নান, শহীদ আহনাফের মা জারতাজ পারভীন প্রমুখ।

জুলাই অভ্যুত্থানে শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফের মা জারতাজ পারভীন বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গত ৪ আগস্ট রাজধানীর মিরপুর-১০ নম্বরে নিহত হয় আমার ছেলে। সে বিএএফ শাহীন কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। তাকে অনেক নিষেধ করেও ঘরে আটকে রাখতে পারিনি। সন্তান হারানোর মতো এ ধরনের পরিস্থিতিতে কাউকে যেন না পরতে হয়।’ সকল হত্যার বিচার চান তিনি।

কাঁদতে কাঁদতে মিনারা বেগম জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সিইও মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধকে জড়িয়ে ধরেন। আজ শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ময়মনসিংহ নগরের টাউন হলের তারেক স্মৃতি অডিটোরিয়ামে
ছবি: প্রথম আলো

‘কেউ তো আমার পুতের মতন বুকে জড়ায়া ধরে না’

অনুদান বিতরণ অনুষ্ঠানে কাঁদতে কাঁদতে প্রবেশ করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত জামান মিয়ার (১৭) মা মিনারা বেগম (৪৬)। তাঁকে হাত ধরে চেয়ারে বসান মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ। এ সময় স্নিগ্ধকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকেন মিনারা। তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন স্নিগ্ধসহ অন্যরা। মিনারা বেগম বলেন, ‘কেউ তো আমার পুতের মতন বুকে জড়ায়া ধরে না। মা কইয়া পুতের ডাক আর হুনি না। আমার বুকের ধন ওরা কইড়া নিল।’

আহাজারি করে মিনারা বেগম আরও বলেন, ‘কত মানুষ দেহি, আমার পুতের মতো কোনো মানুষ তো দেহি না। দেশজুড়ে আন্দোলন হইতাছে, দেখে আগের রাতে নিষেধ করছিলাম আন্দোলনে যাইস না বাপ। কিন্তু আমার কথা শুনে নাই। আমার বাপ তো আর আমার বুকে আইলো না।’

শহীদ জামান মিয়া ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার জাহাঙ্গীরপুর ইউনিয়নের দেউলডাংরা গ্রামের শহীদুল ইসলাম-মিনারা বেগম দম্পতির ছেলে। শহীদুল বাড়ির সামনে ছোট টং দোকান করেন। চার ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে তৃতীয় জামান মিয়া। নরসিংদীর শেখের চর এলাকায় একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করত কিশোর জামান। আন্দোলন চলাকালে ২১ জুলাই কারখানাটির সামনের এলাকায় সে গুলিবিদ্ধ হয়। জামানকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৫ জুলাই সে মারা যায়।

শহীদুল ইসলাম বলেন, অনেক চেষ্টা করেও ছেলেকে পড়ালেখা করাতে পারেননি। কারখানায় কাজ করে অভাবের সংসারে সহযোগিতা করত। দুই ছেলের মধ্যে ছোট ছেলে জামান প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে পাঠাত। কিন্তু সেই ছেলেই গুলিতে মারা গেল। পেটের ডান দিকে গুলি লেগে বাঁ দিক দিয়ে বের হয়ে যায়। তবে এ ঘটনায় তিনি কোনো মামলা করেননি।