ছাত্রলীগের ‘সিট–বাণিজ্যের’ জেরে শিক্ষার্থীকে মারধর, রাজশাহী আইএইচটি বন্ধ
রাজশাহী ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজিতে (আইএইচটি) ‘সিট–বাণিজ্যের’ জের ধরে ছাত্রলীগ নেতার অনুসারীরা এক শিক্ষার্থীকে মারধর করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আহত ওই শিক্ষার্থীকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনার জের ধরে আজ বুধবার থেকে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর নাম মো. হাসান। তিনি আইএইচটির ফার্মেসি বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। গত সোমবার ক্যাম্পাসে তাঁকে মারধর করা হয়। ওই দিনই তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে মো. হাসান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি হোস্টেলের সিটের জন্য আইএইচটি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আল আমিন আকাশকে ১৬ হাজার টাকা দেন। এর পরেও তিনি হোস্টেলে সিটের ব্যবস্থা করেননি। ঘটনার দুই দিন আগে তিনি সভাপতির কাছে টাকা ফেরত চান। টাকা না দিয়ে সভাপতি তাকে উল্টো হুমকি দেন।
হাসান বলেন, গত সোমবার তিনি প্রথম গ্যালারিতে ক্লাস করছিলেন। ক্লাস শেষে হলে পাঁচ-সাতজন ছেলে এসে তাঁকে বলেন, ‘বড় ভাইয়েরা ডাকছেন, তুমি একটু বাইরে আসো।’ ক্লাস আছে জানিয়ে তাঁদের সঙ্গে যেতে অস্বীকৃতি জানান হাসান। মিনিটখানেক পরেই সাত-আটজন শিক্ষার্থী আবারও তাঁকে বাইরে ডাকেন। না যেতে চাওয়ায় ওই দলের তিন-চারজন শিক্ষার্থী তাঁকে বেধড়ক পেটাতে শুরু করেন। তাঁদের কয়েকজন আবার ঠেকানোর চেষ্টা করেন। যাঁরা মারধর করেন, তাঁরা ছাত্রলীগের সভাপতির অনুসারী। এ ঘটনার পর থেকে তিনি নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন। ভীষণ ভয় পাচ্ছেন।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এর আগে একইভাবে গত ২৬ জুলাই ফিজিওথেরাপি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে সভাপতির অনুসারীরা মারধর করেন। আবু সাঈদ হোস্টেলের সিটের জন্য সভাপতিকে আট হাজার টাকা দিয়েছিলেন। তাঁকে সভাপতির কক্ষেই থাকতে দেওয়া হয়েছিল। আবু সাঈদ জানান, তাঁদের চলাফেরা ভালো লাগেনি। এ জন্য রুম ছেড়ে চলে আসতে চাইলে তাঁকে মারধর করা হয়। বিষয়টি শিক্ষকেরাও জানতেন। এক শিক্ষকের মাধ্যমে তিনি তাঁর টাকা আদায় করেছিলেন। এরপর থেকে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের তাঁর সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করে দেওয়া হয়। তাঁর সঙ্গে কথা বলার অভিযোগে শামীম ও স্বপন নামের দুই শিক্ষার্থীকেও মারধর করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে ল্যাব মেডিসিন বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মুরসালিন ছাত্রলীগের নির্যাতনের কারণে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। মুঠোফোনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এলোমেলো কথা বলেন। তাঁর মা বন্যা খাতুন পাশ থেকে ফোন নিয়ে বলেন, তিনি নিজে ছাত্রলীগের সভাপতির সঙ্গে কথা বলে টাকাটা ফেরত চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, তাঁরা গরিব মানুষ, অনেক কষ্টে টাকা জোগাড় করে দিয়েছেন। তারপরেও টাকা ফেরত দেননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, ছাত্রলীগের সভাপতিকে তিনি আট হাজার টাকা দিয়ে হোস্টেলে উঠেছিলেন। কিছু দিন পরে কর্তৃপক্ষ হোস্টেল থেকে বের করে দেয়। এখনো দুই বছর ক্যাম্পাসে চলাফেরা করতে হবে এই জন্য তিনি আর টাকা ফেরত চাননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইএইচটি ছাত্রলীগের সভাপতি আল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ক্যাম্পাসে পরীক্ষা চলছে। এ জন্য পুলিশ-র্যাব মোতায়েন করা হয়েছে। এ অবস্থায় কোনো ছাত্রকে ডেকে নিয়ে মারধর করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ঝামেলাটা ওই শিক্ষার্থীর বন্ধুদের সঙ্গে হয়েছে। সিট–বাণিজের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি আইএইচটিতে কী নিয়মের মাধ্যমে সিট দেওয়া হয়, তার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, এখানে সিট–বাণিজ্যের কোনো সুযোগ নেই।
এ ব্যাপারে রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুম মুবিন বলেন, যাঁরা হামলা করেছেন, তাঁরা সভাপতির অনুসারী কি না, তদন্তের আগেই বলা ঠিক হবে না। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কথাও শোনা যাচ্ছে। তবে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী তাকে ফোন করে তাকে ঘটনাটি বলেছেন। বিষয়টি নিয়ে বসে একটা সমাধান করা যাবে।
এদিকে শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনার পরে আইএইচটি কর্তৃপক্ষ গতকাল মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) একটি অফিস আদেশ জারি করে। এতে বলা হয়, ছাত্রদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের পর উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কারণে ১ মে থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সব ক্লাস বন্ধ থাকবে। পরীক্ষার্থী ছাড়া সব শিক্ষার্থীর মঙ্গলবার সন্ধ্যার মধ্যে হোস্টেল ত্যাগ করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
এ ব্যাপারে রাজশাহী ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজির অধ্যক্ষ ফারহানা হক প্রথম আলোকে বলেন, মারামারিও একটা ইস্যু। তবে ক্যাম্পাসে পানির সংকট, তীব্র তাপপ্রবাহ চলছে। এসব কারণে ক্লাস বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। মারামারির ঘটনা তদন্তের জন্য পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। পরবর্তী তিন কার্যদিবসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দাখিল করার কথা রয়েছে। সিট–বাণিজ্যের লেনদেনের বিষয়টি তিনি জানেন না।