চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষে নতুন সম্ভাবনা পলিকিট

উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ এলাকার পলি থেকে পলিকিট সংগ্রহ করছেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা দলের সদস্যরা
ছবি: সংগৃহীত

পলিকিটের ব্যবহার হ্যাচারিতে চিংড়ির পোনা মৃত্যুর হার কমানোর পাশাপাশি চিংড়ির ডিম উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। তাই উপকূলীয় এলাকার লোনাজলের কাদামাটিতে লুকিয়ে থাকা পলিকিটের বাণিজ্যিক চাষাবাদ দেশের চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষে নতুন দিনের সূচনা হতে পারে বলে মনে করছেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক জাহাঙ্গীর সরকার। সম্প্রতি তাঁর শেষ হওয়া এক গবেষণায় মিলেছে এমন ফলাফল।

জাহাঙ্গীর সরকার প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যে চিংড়ি হ্যাচারিগুলো আছে, সেগুলোতে ব্যাপক পরিমাণে চিংড়ি রোগাক্রান্ত হয়, এমনকি মৃত্যুও ঘটে। এতে চাষিদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে চিংড়ি রপ্তানির ক্ষেত্রে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা কমে যাচ্ছে।

পাশাপাশি দেশের মানসম্মত ফিড ও চিংড়ির গুণগত মান রক্ষা করা যাচ্ছে না। তবে উত্তর ইংল্যান্ড ও চীনে চিংড়ির হ্যাচারিতে পোনা ও প্রাপ্তবয়স্ক চিংড়ির খাবার হিসেবে পলিকিট ব্যবহার করে ব্যাপক সফলতা পাওয়া যাচ্ছে। পলিকিট প্রয়োগ করার ফলে প্রথমত, হ্যাচারিতে চিংড়ির পোনা মৃত্যু হ্রাস করা যায়। দ্বিতীয়ত, চিংড়ির ডিম উৎপাদনের হার আড়াই থেকে তিন গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়। ওই দুই দেশে বছরে প্রায় ২৭০ মেট্রিক টন পলিকিট উৎপাদন করা হয়।

জাহাঙ্গীর সরকার বলেন, বাংলাদেশের উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ এলাকায় লবণাক্ত কাদামাটির এক ফুট গভীরে এক ধরনের পলিকিট বাস করে। এগুলো দেখতে অনেকটা কেঁচোর মতো। ইংল্যান্ড ও চীনের হ্যাচারিতে চিংড়ির খাবার হিসেবে পলিকিট ব্যবহারের বিষয়টিতে অনুপ্রাণিত হয়ে সেটির ওপর গবেষণার সিদ্ধান্ত নেন। এর ধারাবাহিকতায় বিশ্বব্যাংক এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের যৌথ অনুদানে তিনি গবেষণাটি শুরু করেন।

গবেষণাগারে পলিকিট নিয়ে চলছে গবেষণা
ছবি: সংগৃহীত

গবেষণা শুরু যেভাবে

২০১৮ সালে সাতক্ষীরা ও কক্সবাজারে সরকারিভাবে একটি কার্যালয় ভাড়া করে গবেষণা শুরু করা হয়। এর অংশ হিসেবে সাতক্ষীরা থেকে আট প্রজাতির পলিকিট সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু পলিকিটগুলো বৈজ্ঞানিক ও নিখুঁতভাবে শনাক্তকরণের কোনো উপায় এ দেশে নেই। তাই সংগৃহীত নমুনাগুলো ব্রাজিলের একটি পরীক্ষাগারে অধ্যাপক জোয়ানার যৌথ গবেষণায় শনাক্ত করা হয়।

গবেষণায় দেখা যায়, সংগৃহীত আট প্রজাতির পলিকিটের মধ্যে Namalycastis sp প্রজাতি বেশ কার্যকর। এই প্রজাতির পলিকিট সারা বছর প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এ ছাড়া প্রকৃতিতে পাওয়া যায় এমন পলিকিটগুলোর মধ্যে এই প্রজাতি অন্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে বড় আকারের।

অধ্যাপক জাহাঙ্গীর সরকার প্রথম আলোকে বলেন, Namalycastis sp প্রজাতির পলিকিট বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের ভাবনা শুরু করেন তিনি। এ জন্য তিনি শনাক্তকৃত আট প্রজাতির মধ্যে কোনটিতে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড বেশি, তা গবেষণাগারে পরীক্ষা করেন। এতে দেখা যায়, দেশে পাওয়া এই প্রজাতিতে সর্বাধিক ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড বিদ্যমান, যা অন্য দেশের একই প্রজাতির তুলনায় দ্বিগুণের বেশি।

অধ্যাপক জাহাঙ্গীর সরকারের তত্ত্বাবধানে গবেষণাগারে উৎপাদিত পলিকিট
ছবি: সংগৃহীত

গবেষণার ফলাফল

জাহাঙ্গীর সরকারের গবেষণা অনুয়ায়ী, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডযুক্ত ফিশফিড হলো চিংড়ি, কাঁকড়া ও মাছ চাষের জন্য সর্বোচ্চ মানের ফিড। প্রাথমিকভাবে চিংড়ির পোনা, পরিপক্ব চিংড়ি ও কাঁকড়াশিল্পের জন্য এই ফিড অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আবার উত্তর ইংল্যান্ড, নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া ও চীনের বিজ্ঞানীদের সামুদ্রিক পলিকিট ফিড নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, পলিকিটে থাকা ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড চিংড়ির উৎপাদনে ও রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।

জাহাঙ্গীর সরকার বলেন, গবেষণায় তিনি দেখেছেন, কাঁকড়াকে (Scyla olivaceae) শামুকের মাংসপেশি, বিভিন্ন ফর্মুলেটেড ফিড ও Namalycastis প্রজাতিসমৃদ্ধ পলিকিট ফিড খাওয়ানোর পর তাদের বেঁচে থাকার হার, দৈহিক বর্ধন ও ডিম্বাশয়ের ওজন আশ্চর্যজনকভাবে বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া পলিকিট কাঁকড়াকে খাওয়ানোর পর তাদের ডিম অত্যন্ত চর্বিসমৃদ্ধ ও উজ্জ্বল (গাঢ় কমলা) বর্ণের হয়। এতে বিশ্ববাজারে এই কাঁকড়ার চাহিদা এবং জনপ্রিয়তা অনেক বেশি হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

জাহাঙ্গীর সরকারের মতে, ওমেগা-৩–সংবলিত পলিকিট থেকে তৈরি সম্পূরক ফিড কাঁকড়ার খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হলে কাঁকড়ার প্রজননক্ষমতা এবং কাঁকড়ার বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এ ছাড়া চিংড়ি হ্যাচারিতে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করলে চিংড়ি চাষের নতুন দিগন্তের সূচনা হবে, যা হতে পারে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।

বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, খুলনা, কক্সবাজার ও বাগেরহাটে প্রচুর পরিমাণে কাঁকড়া ও চিংড়ি চাষ করা হয়। ২০১৯-২০ সালে দেশে চিংড়ির মোট উৎপাদন ছিল প্রায় ২ দশমিক ৭০ লাখ মেট্রিক টন। এ ছাড়া ২০১৯-২০ সালে দেশে প্রায় ৪৩টি বাগদা হ্যাচারি এবং ৩৩ গলদা হ্যাচারি ছিল। এসব হ্যাচারিতে প্রায় ৭ লাখ ৯২ হাজার ৯৫২ বাগদা চিংড়ির পোনা এবং প্রায় ২৩৬ লাখ গলদা চিংড়ির পোনা উৎপাদিত হয়েছে।