গজারিয়ার ফুলদি নদী
সেতু না হওয়ায় ভোগান্তি
গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে ২০০২ সালে নদীটির ওপর সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল। ২৩ বছরেও কাজ শুরু হয়নি।
‘দেশ স্বাধীন হওনের পর থেইকা নৌকায় কইরা নদী পার হইতাছি। প্রতিবার নির্বাচনের সময় হেরা (জনপ্রতিনিধিরা) গলা ফাডায়া কয় আমাগো কষ্টের দিন শেষ হইবো। নদীর ওপরে দিয়া ব্রিজ কইরা দিব। কই ব্রিজ তো আর অয় না। আমরা কি সরকারকে ভ্যাট, ট্যাক্স দেই না, আমরা কি দেশের জনগণ না, কেন এখানে একটা ব্রিজ বানায় না সরকার?’
কথাগুলো বলছিলেন মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার গোসাইরচর এলাকার বাসিন্দা হাবিবুর রহমান (৭০)। সম্প্রতি গজারিয়া ও ইমামপুর ইউনিয়নের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ফুলদি নদীর রসুলপুর ঘাটে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। মৃত্যুর আগে নদীর ওপর সেতু দেখে যেতে পারবেন কি না, এ নিয়ে আক্ষেপ করেন তিনি বলেন, ‘আমরা আর কত কষ্ট কইরা নদী পার হমু। আমাগো কষ্ট কি আর শেষ হইবো না?’
রসুলপুর খেয়াঘাটে ট্রলারে পার হয়ে বিদ্যালয়ে যাচ্ছিল গজারিয়া পাইলট মডেল হাই স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মোহাম্মদ নাফিস ও অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী উম্মে হাবিবা। তাদের বাড়ি রসুলপুর মোল্লাবাড়ি।
আমরা আর কত কষ্ট কইরা নদী পার হমু। আমাগো কষ্ট কি আর শেষ হইবো না?
নাফিস বলে, ‘আমাদের মতো এমন হাজারো স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন এমন দুর্ভোগ নিয়ে নদী পার হচ্ছে। একটি সেতু হলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত।’
সরেজমিনে দেখা যায়, ফুলদি নদীর ওপর সেতু না থাকায় দুটি ইঞ্জিতচালিত কাঠের নৌকা এবং সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরের দেওয়া একটি ফেরির মাধ্যমে যাত্রী, অটোরিকশা এবং সিএনজিচালিত অটোরিকশা পারাপার হচ্ছে। স্কুল, কলেজ, বিভিন্ন সরকারি অফিস-আদালতের চাকুরিজীবীরা নদীর একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাতায়াত করছে। ট্রলারগুলো যাত্রী নামানোর কয়েক মিনিটের মধ্যেই যাত্রীতে পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
এ সময় স্থানীয় এবং এ নৌপথে যাতায়াতকারী কমপক্ষে ১৫ জনের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, গজারিয়া উপজেলার থানা, হাসপাতাল, ফায়ারসার্ভিসসহ সব সরকারি অফিস ফুলদি নদীর পূর্ব পাশে। আবার, নদীর পশ্চিম পাশের গজারিয়া ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি উচ্চবিদ্যালয়, মাদ্রাসা। এ ছাড়া পূর্ব পাশের ইউনিয়নগুলোর বাসিন্দাদের মুন্সিগঞ্জ শহরে আসতে হলে ফুলদি নদী পাড়ি দিতে হয়। প্রতিদিন মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলা ও গজারিয়া উপজেলার অন্তত ২৫-৩০ হাজার মানুষ এ নৌপথে যাতায়াত করে।
কুমিল্লার দাউদকান্দি ও সোনারগাঁও উপজেলার ৮-১০টি গ্রামের মানুষ সহজে কুমিল্লা-চট্টগ্রাম যেতে ফুলদি নদী পারাপার হন। গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে ২০০২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী নাজমুল হুদা ফুলদি নদীর ওপর সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। ২৩ বছর পার হলেও সেতু নির্মাণ শুরু হয়নি।
গজারিয়ার সোনারকান্দি এলাকার সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা মাহবুবুর রশিদ (৬৫) বলেন, ‘গজারিয়া উপজেলাকে দুই ভাগে ভাগ করে রেখেছে ফুলদি নদী। যুবক বয়স থেকে এ নদীর উপর সেতু নির্মাণের কথা শুনছি। সেতু আর হচ্ছে না। মরার আগে সেতু দেখে যেতে পারব কি না, তা–ও জানি না। মানুষ, যানবাহনের জন্য দ্রুত সেতু করা দরকার।’
সেতুটি কেন হচ্ছে না তা বুঝতে পারছেন না গজারিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘একটি সেতুর অভাব পুরো উপজেলাকে দুভাগে ভাগ করে রেখেছে। ফুলদি নদীতে সেতুর জন্য জনপ্রতিনিধিরা বারবার চেষ্টা করছেন। কী কারণে এখানে সেতু হচ্ছে না, সেটা আমরা জানি না। আমি নিজেও জনপ্রতিনিধি হওয়ার আগে মানুষকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। সংশ্লিষ্ট দপ্তরসহ, মাসিক সমন্বয় সভায় বারবার বলে যাচ্ছি। কাজ হচ্ছে না।’
মরার আগে সেতু দেখে যেতে পারব কি না, তা–ও জানি না। মানুষ, যানবাহনের জন্য দ্রুত সেতু করা দরকার।
নারায়ণগঞ্জ সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহানা ফেরদৌস জানেন, এ নদীর ওপর ৪০০ মিটার সেতু ও দুই পাশে ২০০ মিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এজন্য বিআইডব্লিউটিএ থেকে একটি ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করা হয়েছে। ছাড়পত্র পেলে সেতুর জন্য নকশা করা হবে। সেই সঙ্গে সেতু নির্মাণের প্রাথমিক কাজগুলোও চলতি অর্থ বছরের মধ্যে করা হবে। বরাদ্দ চেয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। সেখান থেকে বরাদ্দ পেলে ২০২৩ সালের মধ্যে সেতুর কাজ শুরু করা যেতে পারে।