১৪ কর্মকর্তা দিয়ে ৭৩২ বিদ্যালয়ের তদারকি
সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সংকটে লক্ষ্মীপুর জেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তদারকি কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এ জেলায় বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৭৩২ হলেও কর্মকর্তা মাত্র ১৪ জন। ওই কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। যথাযথ তদারকি না থাকায় বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার মান নিম্নমুখী হবে বলে আশঙ্কা করছেন অভিভাবকেরা।
জেলার ৭৩২টি বিদ্যালয় পরিদর্শনের জন্য ৩৩টি সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার পদ রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে কর্মরত আছেন ১৪ জন সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা। দীর্ঘ প্রায় ৮ থেকে ১০ বছর ধরে ১৯টি পদ শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলাতেই ১০টি পদ শূন্য রয়েছে। সে হিসাবে গড়ে ৫২টি বিদ্যালয় একজন কর্মকর্তার দায়িত্বে রয়েছে। প্রতিদিন একটি বিদ্যালয় পরিদর্শন করলে, একজন কর্মকর্তার সব কটি বিদ্যালয় পরিদর্শন শেষ করতে আড়াই মাস প্রয়োজন। অথচ ২০ থেকে ২৫টি বিদ্যালয় মনিটরিংয়ের জন্য একজন এটিও থাকার নিয়ম রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যালয়গুলোতে তদারকি কমে গেলে শিক্ষার মানোন্নয়ন হবে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে বিপর্যয়ের আশঙ্কায় রয়েছে ‘সবার জন্য শিক্ষা।’
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, লক্ষ্মীপুর জেলার ৫টি উপজেলায় ৭৩২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এ বিদ্যালয়গুলোতে প্রায় চার লাখ শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। বিদ্যালয়গুলো পরিদর্শনের জন্য ৩৩টি সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তার পদ আছে। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় ৮ থেকে ১০ বছর ধরে ১৯টি পদ শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় ১৩টি সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার পদের মধ্যে ৩ জন, রামগঞ্জে ৭টি পদের মধ্যে ৪ জন, রায়পুরে ৫টি পদের মধ্যে ৩ জন, রামগতিতে ৬টি পদের মধ্যে ৩ জন ও কমলনগর উপজেলায় ২টি পদের মধ্যে ১ জন সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কর্মরত।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দালাল বাজার ইউপির একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ১৫ বছর আগে অবসর নেন মো. আমির হোসেন। তিনি জানান, তাঁরা যখন শিক্ষকতা করতেন, তখন সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তাদের (এটিও) নিয়ে আতঙ্কে থাকতেন। কারণ, এটিওরা যখন-তখন বিদ্যালয়ে এসে বিভিন্ন অনিয়ম খুঁজে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেন। এ জন্য শিক্ষকেরা বিদ্যালয়ে যথাসময়ে আসাসহ পাঠদানে মনোযোগী ছিলেন। আর এখন এটিওরা বিদ্যালয়ে আসেন কালেভদ্রে।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে রায়পুর উপজেলার কেরোয়া ইউনিয়নের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি জানান, তাঁর বিদ্যালয়ে প্রায় দিনই শিক্ষকেরা এক থেকে দেড় ঘণ্টা দেরিতে আসেন। ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাস না করে মাঠে খেলাধুলায় সময় কাটায়। এ নিয়ে তিনি শিক্ষকদের সঙ্গে অনেক বাগ্বিতণ্ডা করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। গ্রামের বিদ্যালয়গুলোতে আগের মতো তদারকি নেই। এ কারণেই বর্তমানে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। গত তিন মাসেও তাঁর বিদ্যালয়টি পরিদর্শনের জন্য কোনো সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা আসেননি।
রামগঞ্জ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি শেখ জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যালয়ের তুলনায় এমনিতেই এটিওর পদ অনেক কম। তার ওপর আবার অনেক পদশূন্য বিদ্যালয়ে যত বেশি তদারকি হবে, তত বেশি সুফল বাড়বে। তদারকি থাকলে শিক্ষার মান বাড়ে। এ জন্য বিদ্যালয়গুলোর মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। এটার কোনো বিকল্প নেই।
রামগঞ্জে বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ফারহানা হক। তিনি জানান, ১ জন এটিও মাসে প্রায় ১০টি বিদ্যালয় পরিদর্শন করতে পারেন। সব কটি বিদ্যালয় পরিদর্শন করতে ১০ থেকে ১১ মাস প্রয়োজন। তা ছাড়া বিদ্যালয় পরিদর্শন ছাড়াও তাঁদের কার্যালয়ের অনেক কার্যক্রম করতে হয়। বিদ্যালয়গুলোতে তদারকি কমে গেলে শিক্ষার মানোন্নয়ন কমে যায়। এতে সরকারের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে বলেও জানা তিনি।
তিনজন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জানান, পঞ্চম শ্রেণি থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া অনেক ছাত্র-ছাত্রী গণিত ও ইংরেজিতে কাঁচা। অনেকে আবার নিজের নাম পর্যন্ত ইংরেজিতে লিখতে পারে না। বিদ্যালয়ে পাঠদানের সময় এতে তাদের ভীষণ বেগ পেতে হয়। এ জন্য তৃণমূল পর্যায়ের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা উচিত।
জানতে চাইলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুল লতিফ মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, এটিওর সংকট দীর্ঘদিন থেকে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানানো হয়েছে। ১৪ জন এটিওর পক্ষে মাসে ৭৩২টি বিদ্যালয় মনিটরিং করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ২০ থেকে ২৫টি বিদ্যালয় মনিটরিংয়ের জন্য ১ জন এটিও থাকার নিয়ম রয়েছে। এটিও কম থাকার কারণে বিদ্যালয় মনিটরিং কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।