বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যেতে চায় তারা

একসময় আবাদি জমি, বসতভিটা সবই ছিল ইশরাত জাহানের পরিবারের। দুই বছর আগে তার মায়ের চিকিৎসার জন্য সবকিছু বিক্রি করতে হয়। ঠাঁই হয় নানার বাড়িতে। কৃষক বাবা ইসমাইল হোসেন শুরু করেন রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ। ইশরাতের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু থেমে যায়নি সে। পড়ার খরচ জোগাতে প্রায়ই প্রতিবেশীর বাড়িতে ধান মাড়াইয়ের কাজ করেছে। এভাবে প্রতিকূলতা পেরিয়ে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে সে।

ইশরাত জাহানের বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার হাড়িয়ারকুঠি ইউনিয়নের কিসামত মেনানগর সরকারপাড়া গ্রামে। তার মতোই সংগ্রাম করে পড়াশোনা করে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের অবন্তি সূত্রধর, বরিশালের গৌরনদী উপজেলার পশ্চিম শাওড়া গ্রামের হুমায়রা ও পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার সাদিয়া সুলতানা। কিন্তু কলেজে পড়ার খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই তাদের।

টিউশনি করিয়ে লেখাপড়া চলেছে হুমায়রার

বরিশালের গৌরনদী গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে হুমায়রা। তার বাবা নুরুল আলম একটি কিন্ডারগার্টেন মাদ্রাসায় ছোট পদে চাকরি করেন। মা হাসিনা সুলতানা গৃহিণী। হতদরিদ্র নুরুল আলম জানান, নিজের আয় দিয়ে ছয় সদস্যের পরিবার কোনোরকমে চলছে। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার পর তিনি মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে চান। কিন্তু হুমায়রা পণ করে বসল লেখাপড়া করবেই। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠার পরই সে শিশুদের প্রাইভেট পড়ানো শুরু করে। অষ্টম শ্রেণিতে জিপিএ-৫ পাওয়ার পর পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ আরও বেড়ে গেল। তখন প্রাইভেট পড়ানো আরও বাড়িয়ে দিল। নিজের খরচ চালিয়ে সংসারেও কিছু সাহায্য করে।

হুমায়রা বলে, অনেক কষ্ট করে পড়েও জিপিএ-৫ পাওয়ায় সে ও পরিবারের সবাই আনন্দিত। কিন্তু কলেজে ভর্তি ও পড়ার খরচ নিয়ে সবাই চিন্তিত। পড়াশোনার সুযোগ পেলে সে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হয়ে দেশের জন্য কাজ করতে চায়। মা–বাবার দুঃখ ঘোচাতে চায়।

পশ্চিম শাওড়া গ্রামের মনিরুজ্জামান বলেন, ‘হুমায়রা যেভাবে অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে পড়াশোনা করে সফল হয়েছে, এতে আমরা গ্রামবাসী ওকে নিয়ে গর্ব করি। অভাবী পরিবারের জন্য হুমায়রা অনুকরণীয় হতে পারে।’

শিক্ষক হতে চায় অবন্তি

রায়গঞ্জ পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের ধানগড়া পালপাড়া এলাকার কাঠমিস্ত্রি নির্মল চন্দ্র সূত্রধর ও গৃহিণী সুবর্ণা রানী সূত্রধরের দুই মেয়ের মধ্যে ছোট অবন্তি সূত্রধর। সে এবারে ধানগড়া উচ্চবিদ্যালয়ের মানবিক বিভাগ থেকে সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে। নির্মল চন্দ্র বলেন, মেয়েটার পড়ালেখার প্রতি খুব ঝোঁক। সামান্য আয়ে সংসার চালানোই কঠিন, মেয়েদের পড়ালেখার খরচ জোগানো আরও কঠিন। সম্বল বলতে বাড়ির চার শতক জায়গা। একটু সহযোগিতা পেলে অনেক উপকার হতো। পড়ালেখার পাশাপাশি ছবি আঁকতে মেয়ের খুব আগ্রহ বলে জানালেন মা সুবর্ণা রানী।

অবন্তি সূত্রধর বলে, কাকা প্রশান্ত কুমার সূত্রধরের অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায় এসএসসির গণ্ডি পার হয়েছে। কিন্তু কলেজে কীভাবে পড়বে, সেই চিন্তায় সবাই অস্থির হয়ে আছে। পড়ালেখা শেষ করে শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় নিজেকে উৎসর্গ করতে চায় সে।

ধানগড়া উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সোনাতন কুমার বলেন, হৃদয়বান মানুষের একটু সহযোগিতা পারে অবন্তি সূত্রধরের জীবন পাল্টে দিতে।

অভাবের কাছে হারেনি ইশরাত

রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ডাঙ্গীরহাট স্কুল ও কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে ইশরাত জাহান।

শিক্ষক ও পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁর মা জাহানুর বেগমের কয়েক দফা অস্ত্রোপচার ও চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে আবাদি জমি ও বসতভিটা বিক্রি করতে হয়। এখন কৃষক ইসমাইল রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করে সংসারের খরচ, স্ত্রীর ওষুধ, মেয়ের লেখাপড়ার ব্যয় চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। ইসমাইল বলেন, স্ত্রী এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। মেয়েটা অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করে জিপিএ–৫ পেয়েছে। কিন্তু ওকে কলেজে পড়ানোর সামর্থ্য নেই। এখনো মেয়ের এসএসসির ফরম পূরণের টাকা পরিশোধ করতে পারেননি তিনি।

ইশরাত জাহান বলে, ‘সারাক্ষণ দুশ্চিন্তায় কাটে যদি লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়, আমি ঝরে পড়ে যাই। তাহলে আমার স্বপ্নগুলো মরে যাবে।’ ডাঙ্গীরহাট স্কুল ও কলেজের সহকারী শিক্ষক আক্তারুজ্জামান তুফান বলেন, একটু সহায়তা পেলে মেয়েটি ভবিষ্যতে আরও ভালো করবে।

স্কুলে সাদিয়াই একমাত্র জিপিএ-৫ পেয়েছে

মির্জাগঞ্জ উপজেলার কিসমত শ্রীনগর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ–৫ পেয়েছে সাদিয়া সুলতানা। তার বাবা দেলোয়ার হোসেন রিকশা চালিয়ে ছয় সদস্যের পরিবারের খরচ মেটান। ওই আয় দিয়েই চলে সন্তানদের পড়াশোনা। চার বোনের মধ্যে সাদিয়ার বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। ছোট দুই বোন দুটি স্থানীয় মাদ্রাসায় পড়ে।

দেলোয়ার হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে সাত দিন বিদ্যুৎ ছিল না। এ সময় রিকশায় চার্জ দিতে পারেননি। রিকশা চালাতেও পারেননি। শুধু শুকনা খাবার খেয়ে সাত দিন পার করেছেন। তিনি আরও বলেন, শিক্ষকদের সহযোগিতায় অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করেছে সাদিয়া। ঠিকমতো তিন বেলা খেতেও দিতে পারেননি। একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির জন্য সে স্থানীয় কলেজের আবেদন করেছে। ওর লেখাপড়ার খরচ কীভাবে চালাবেন জানেন না।

কিসমত শ্রীনগর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) মো. হারুন-অর-রশিদ বলেন, সাদিয়া অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থী। ওর বাবার রিকশার ওপর ভিত্তি করে ওদের পরিবার চলে। বিদ্যালয় থেকে ২০২৪ সালে ৫১ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। একমাত্র সাদিয়াই জিপিএ–৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। একটু সহযোগিতা পেলে সাদিয়া জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন প্রতিনিধি, রায়গঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, তারাগঞ্জ, রংপুর, গৌরনদী, বরিশাল ও মির্জাগঞ্জ, পটুয়াখালী]