ভোট হয় না, ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ

গতকাল চেম্বারের পর্ষদ থেকে জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি তরফদার রুহুল আমিন ও পরিচালক জহিরুল ইসলাম চৌধুরী পদত্যাগ করেছেন।

চট্টগ্রাম চেম্বারের লোগোছবি: চেম্বারের ফেসবুক থেকে

নির্বাচন না হওয়া, ব্যবসায়ীদের বঞ্চিত করা এবং ভোট করতে না দেওয়া নিয়ে চট্টগ্রাম চেম্বার ঘিরে কয়েক বছর ধরে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ক্ষোভ ছিল। তবে গত ৫ আগস্ট দেশে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর চেম্বার ঘিরে এ ক্ষোভ আরও বেশি প্রকাশ পেয়েছে। ব্যবসায়ীদের বঞ্চিত করে ‘পরিবারতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করার অভিযোগে ইতিমধ্যে দুই দফা মানববন্ধনও করেছেন বঞ্চিত ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে চেম্বার ঘিরে উত্তেজনা আরও বেড়েছে পর্ষদ থেকে গতকাল বুধবার দুজনের পদত্যাগের পর।

সর্বশেষ গত ২৫ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের সামনে জড়ো হন ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রাম বঞ্চিত ব্যবসায়ী ফোরামের ব্যানারে ৩৬টি সংগঠনের প্রতিনিধিরা এদিন চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সামনে (সিসিসিআই) মানববন্ধন করেন। তাঁদের মূল দাবি, চেম্বারে সুষ্ঠু নির্বাচন। জানা গেছে, এর আগে টানা পাঁচ নির্বাচনে ভোটাভুটি হয়নি চট্টগ্রাম চেম্বারে। এ কারণে বর্তমান কমিটি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে শুরু থেকে।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম চেম্বারে পরিবারতন্ত্র ও স্বৈরশাসন চলছে। ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটিকে ১৭ বছর ধরে স্বৈরশাসনের আজ্ঞাবহ করে রাখা হয়েছে। নির্বাচন হলেও তাতে ব্যবসায়ীদের ভোট দিতে দেওয়া হচ্ছে না। অনেক ব্যবসায়ীকে সদস্যপদ না দিয়ে বঞ্চিত করা হচ্ছে। চেম্বারের বর্তমান যে কমিটি, তা ভেঙে নতুন কমিটি করার দাবিও জানান তাঁরা।

বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকেলস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান বলেন, চেম্বার নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনেক দিনের ক্ষোভ রয়েছে। ভোট না হওয়া, ব্যবসায়ীদের বঞ্চিত করা এবং চেম্বারে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার কারণে সবার মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। সুষ্ঠু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চান বঞ্চিত ব্যবসায়ীরা।

 জানতে চাইলে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি ওমর হাজ্জাজ প্রথম আলোকে বলেন, চেম্বার সব সময় ব্যবসায়ীদের জন্য কাজ করেছে। এরপরও ব্যবসায়ীদের দাবিগুলো বাণিজ্য উপদেষ্টা ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জানানো হবে। এরপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যা সিদ্ধান্ত নেবে, সেটি চেম্বারের পরিচালনা পর্ষদ মেনে নেবে।

ভোট হয়নি টানা পাঁচবার

চট্টগ্রাম চেম্বারে সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছে গত বছরের আগস্টের শুরুতে। তবে তাতে ভোট হয়নি। প্রথমে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরিচালকেরা নির্বাচিত হয়েছেন, এরপর তাঁরা সভাপতি নির্বাচিত করেছেন। এটি নিয়ে টানা পাঁচবার ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এ কারণে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছিল।

চট্টগ্রাম চেম্বারের বর্তমান সভাপতি ওমর হাজ্জাজ। তিনি চট্টগ্রাম-১১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) এম এ লতিফের তৃতীয় সন্তান। ওমর হাজ্জাজ ২০১৭-১৯ সাল মেয়াদে প্রথমে বিনা ভোটে পরিচালক হন। এরপর ২০১৯-২১ মেয়াদে একইভাবে জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি হন। একবার বিরতি দিয়ে এবারের কমিটিতে তিনি সভাপতি হয়েছেন। এম এ লতিফ ২০০৮-১০ মেয়াদে চেম্বারের সভাপতি ছিলেন।

চট্টগ্রাম চেম্বারে সর্বশেষ ভোটাভুটি হয়েছিল ২০১৩ সালের ৩০ মার্চ। ওই নির্বাচনে এম এ লতিফ-সমর্থিত মাহবুবুল আলম-নুরুন নেওয়াজ সেলিম পরিষদ ২৪ পদের মধ্যে ২০টিতে জয়লাভ করে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবাদে মাহবুবুল আলম প্রথমবারের মতো সভাপতি হন।

এর পরের চারবার তাঁর প্রতিপক্ষ হিসেবে কোনো প্যানেল বা প্রার্থী দেখা যায়নি। তাই ভোটাভুটিও হয়নি। মাহবুব আলম বর্তমানে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি। তাঁর মেয়ে রাইসা মাহবুব বর্তমানে চট্টগ্রাম চেম্বারের সহসভাপতি।

চেম্বারের সাবেক সভাপতি আমীর হ‌ুমায়ূন মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন ভোট না হওয়ার মানে হলো ব্যবসায়ীরা নিজেদের মতামত দিতে পারেননি। যে নেতৃত্ব আসছে, সেটি যদি ব্যবসায়ীদের ভোটের ভিত্তিতে না আসে, তার অর্থ হলো সেটি ব্যবসায়ীদের জন্য কাজ করবে না। পারিবারিক সদস্যদের নিয়ে কমিটি করা ব্যবসায়ীদের স্বার্থে নয়, বরং নিজেদের কর্তৃত্ব রাখতে।

তিনজনের পদত্যাগ

১৯০৬ সালে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স নামে এই চেম্বার যাত্রা শুরু করে। প্রথমবার সভাপতি হন জে আই ব্রাউন। ইংরেজ আমলে ইউরোপীয়রা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই চেম্বারে। স্বাধীনতার পর থেকে চেম্বারের নেতৃত্ব দেওয়া আটজন ব্যবসায়ী পরে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আবার আটজনের পাঁচজন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও ছিলেন। এ কারণে এই চেম্বারের নেতৃত্বের প্রতি ব্যবসায়ীদের আগ্রহ ছিল বেশি।

তবে টানা পাঁচ মেয়াদে ভোট না হওয়ায় ঐতিহ্যবাহী চেম্বারটির নেতৃত্ব নিয়ে আগ্রহ কমছে ব্যবসায়ীদের।

এর মধ্যে গতকাল চেম্বারের পর্ষদ থেকে জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি তরফদার রুহুল আমিন ও পরিচালক জহিরুল ইসলাম চৌধুরী পদত্যাগ করেছেন। এ ছাড়া গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর দায়িত্ব নেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে পরিচালক হিসেবে প্যাসিফিক জিনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর পদত্যাগ করেন।

চেম্বারের ১১৮ বছরের ইতিহাসে পরিচালনা পর্ষদ থেকে পদত্যাগের ঘটনা এই তিনটি। জানতে চাইলে সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম চেম্বারের বর্তমান কমিটি ব্যবসায়ীদের স্বার্থে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। তাই আমার মনে হয়েছে, এই পদ থেকে আমার সরে দাঁড়ানো উচিত।’