কুষ্টিয়ায় বালুর ঘাট ভাগাভাগি নিয়ে বিএনপির দুই পক্ষের উত্তেজনা, অস্ত্রের মহড়া
কুষ্টিয়ায় গড়াই নদের খনন করে তোলা বালু বিক্রির টাকা ভাগাভাগি নিয়ে স্থানীয় বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা চলছে। এতে মহাসড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ সমাবেশ, অস্ত্রের মহড়া ও গুলি ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িঘর ও বিএনপি কার্যালয় ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে।
কুষ্টিয়া পৌরসভার ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের জুগিয়া এলাকায় গতকাল মঙ্গলবার ও আজ বুধবার দুই দিন ধরে এ ঘটনা ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ওই বালুঘাট থেকে সাময়িকভাবে বালু অপসারণ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে জেলা প্রশাসন।
কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, গড়াই নদ খননের ফলে তোলা বালু স্তূপাকারে নদের পাড়ে রাখা হয়েছে। এই বালু এখন অপসারণের জন্য ইজারা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে নদের জুগিয়া ও গোপীনাথপুর মৌজায় রাখা বালুর স্তূপ সরানোর জন্য চলতি বছরের ১০ জুন মেসার্স মেহেদী এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মহিদুল ইসলামকে সর্বোচ্চ ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা দরদাতা হিসাবে কার্যাদেশ দেয় পাউবো। এ কার্যাদেশে আগামী বছরের ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত বালু অপসারণের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এর পর থেকে মহিদুল বালু অপসারণ করে বিক্রি করে আসছিলেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মহিদুল ইসলাম পৌরসভার ১৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও একই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। এক যুগের বেশি সময় ধরে বালুঘাট তাঁর নিয়ন্ত্রণে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে জুগিয়া বালুঘাটের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করে স্থানীয় বিএনপির দুটি পক্ষ। এতে বারখাদা ও জুগিয়া এলাকায় বিএনপির নেতা-কর্মীরা দুটি পক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়েন। এরপর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি আমিরুল ইসলাম, শহর যুবদলের সদস্যসচিব জিল্লুর রহমান ওরফে জনি, ছাত্রদল নেতা রাকিবুল ইসলাম ওরফে রাব্বির সঙ্গে মহিদুলের সমঝোতা হয়। সমঝোতা অনুযায়ী আওয়ামী লীগ নেতা মহিদুল পাবেন ৪০ শতাংশ এবং বিএনপি নেতাদের মধ্যে ৬০ শতাংশ অর্থ ভাগাভাগির শর্তে কয়েক দিন আগে বালু অপসারণ শুরু হয়। এ সমঝোতার সঙ্গে জড়িত নেতা-কর্মীরা জেলা বিএনপির সদস্যসচিব জাকির হোসেন সরকারের অনুসারী। প্রতিদিন সেখান থেকে দেড় শতাধিক ট্রাকে অন্তত চার–পাঁচ লাখ টাকার বালু বিক্রি হয়।
বালু বিক্রির টাকার ভাগ না পেয়ে জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সোহরাব উদ্দিনের অনুসারী শাহজাহান আলী ওরফে সাজুর অনুসারী কর্মীরা এলাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে বালু পরিবহন ও বিক্রির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তাঁদের দাবি, বালুবাহী ট্রাকের কারণে এলাকার প্রায় দুই কিলোমিটার পাকা সড়ক নষ্ট হয়ে গেছে। তাঁরা জেলা প্রশাসনের কাছে বালুঘাট ইজারা বন্ধসহ বালুবাহী ট্রাক বন্ধের দাবি জানান।
গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জুগিয়া ঘাটে বালু অপসারণ নিয়ে উত্তেজনা শুরু হয়। বিএনপি নেতা শাহজাহান আলী এলাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে বালু পরিবহন বন্ধের দাবি জানালে মহিদুল ও বিএনপির একটি পক্ষের নেতারা ক্ষুব্ধ হন। এ সময় সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন আহত হন। সাজুর অনুসারী ১৫ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান ও তাঁর অনুসারীরা মহাসড়ক অবরোধ করে টায়ারে আগুন ধরিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করে।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, একই ঘটনায় আজ বালুঘাটের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে মহিদুল, তাঁর ভাই-ভাতিজা আর বিএনপির একটি পক্ষ এক হয়ে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে এলাকায় মহড়া দেন। এ সময় বিএনপি নেতা শাহাজাহান, মিজানুর রহমানসহ এলাকার লোকজন একত্র হয়ে তাঁদের প্রতিহত করতে পাল্টা হামলা চালান। এ সময় উভয় পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। অস্ত্র হাতে এক যুবককে দৌড়াতে দেখা গেছে। কয়েকটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়েছে। গুলির শব্দও শোনা গেছে। অস্ত্রের মহড়ার কয়েকটি ভিডিও প্রথম আলোর হাতে এসেছে।
শাহজাহান আলী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতা মহিদুলের সঙ্গে ওয়ার্ড বিএনপির কিছু নেতা একসঙ্গে বালু উত্তোলন করছিলেন। এলাকার লোকজন এক হয়ে তাঁদের বাধা দিলে অস্ত্র হাতে হামলা চালায় মহিদুলের ক্যাডার বাহিনী। তারা এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করেছে। বালু উত্তোলনের ফলে সড়ক নষ্ট হওয়ায় এলাকার লোকজন চলাফেরা করতে পারছে না। এ কারণে পুরো এলাকাবাসী এক হয়ে তাদের প্রতিহত করার ডাক দিয়েছে।’
এলাকাবাসী আরও জানান, জুগিয়া কানাবিলের মোড়ে আবদুল আজিজের ছেলে ইশতিয়াক অস্ত্র হাতে মহড়া দেন এবং গুলি ছোড়েন। এ সময় এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এলাকাবাসীর একটি অংশও সাজুর (শাহজাহান আলী) সঙ্গে এক হয়ে মহিদুলের লোকজনকে ধাওয়া দিলে তাঁরা পালিয়ে যান। পরে মহিদুলের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর চালান তাঁরা।
এলাকার বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম বলেন, জুগিয়ায় বালু তোলার কারণে এলাকায় বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কুষ্টিয়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহবুব উল আলম হানিফ ও তাঁর চাচাতো ভাই আতাউর রহমানের দোসর মহিদুল ইসলাম। তাঁর কারণে এলাকায় মানুষ বসবাস করতে পারছেন না। বালুর ট্রাকের কারণে এলাকার দুই কিলোমিটার পাকা সড়ক কাচা হয়ে গেছে। এ কারণে মানুষ ক্ষুব্ধ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন বলেন, হানিফ ও আতার সাহায্য নিয়ে দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় ধরে মহিদুল বালুঘাটের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছেন। এর আগে অবৈধভাবে এ ঘাট থেকে বালু উত্তোলন করা হতো। পরে গড়াই খননের রাখা বালু বিক্রির জন্য দরপত্র করা হয় কয়েক বছর ধরে। মহিদুলের সঙ্গে নিয়ে বিএনপির আমিরুল ইসলাম, মিল্টন, জনি (জিল্লুর রহমান) এখন এক হয়ে বালু তুলছিলেন। এসব নিয়ে বিএনপি নেতা সাজুর (শাহজাহান আলী) লোকজন এলাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন।
তবে ১৪ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘আওয়ামী লীগের ক্যাডার জিকু, রাকিব, রানাসহ আরও অন্যরা মিলে বিএনপির পার্টি অফিসে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেছে। তারা বিএনপি নেতা মিজানুর রহমানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আমাদের লোকজনের ওপর হামলা করেছে। আমার সঙ্গে মহিদুলের কোনো সম্পর্ক নেই। বালুঘাট থেকে কোনো ভাগ খাই না।’
কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন ও মিডিয়া) পলাশ কান্তি নাথ প্রথম আলোকে বলেন, দুই দিন ধরে ওই এলাকায় বালুঘাট নিয়ে উত্তেজনা বিরাজ করছে। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে কাজ করছে। গুলি ছোড়ার বিষয়টি শোনা যাচ্ছে। অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেওয়ার বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আবদুল ওয়াদুদ প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাস্থলে ম্যাজিস্ট্রেট পাঠানো হয়েছিল। সার্বিক দিক বিবেচনা করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় সাময়িকভাবে বালু অপসারণ বন্ধ রাখা হয়েছে। পরে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।