পাহাড়ে ঘেরা চাম্বি হ্রদে কেন যাবেন

চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার চুনতি ইউনিয়ন ও বান্দরবানের আজিজনগরের ১০০ একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত চাম্বি হ্রদের স্বচ্ছ টলটলে জল মুগ্ধ করবে পর্যটকদের। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে তোলাছবি: প্রথম আলো

টলটলে জলে খেলে বেড়াচ্ছে মাছের দল। তিন দিকের সবুজ পাহাড়ি অরণ্য নুয়ে পড়ে মুখ দেখছে কাচস্বচ্ছ জলে। একপাশে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। নগরের, মানুষের কোনো কোলাহল নেই। আছে হরেক রকম পাখির কলকাকলি। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার কৃত্রিম হ্রদ চাম্বি পরিযায়ী পাখি আর নিসর্গপ্রিয় পর্যটকের জন্য মেলে বসেছে আসন্ন শীতের পসরা। হ্রদের দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তর পাশে বিচিত্র বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদে সমৃদ্ধ চুনতি অভয়ারণ্য। পূর্বপাশে ফসলি জমি।

চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি ইউনিয়নের পানত্রিশা, ফারাঙ্গা ও নারিশ্চা গ্রাম এবং পাশের বান্দরবানের আজিজনগর ইউনিয়নের পূর্ব চাম্বি গ্রাম নিয়ে ১০০ একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই হ্রদ। হ্রদের সৃষ্টি হয়েছে বান্দরবানের পাহাড়ের কয়েকটি সক্রিয় ঝরনা থেকে।

এখানে এলেই দেখা মিলবে ঘাসের ডগায় হেমন্তের শিশির। অগ্রহায়ণের শুরুতেই প্রকৃতি দিচ্ছে শীতের আগমন বার্তা। কুয়াশার চাদর জড়িয়ে সকাল নামছে। হেমন্তের পড়ন্ত বিকেলে চাম্বি হ্রদে নৌকাভ্রমণ মনকে শান্ত করে তুলবে। সঙ্গে দেখা যাবে সাদা বকের ইতিউতি মাছ খোঁজা। নৌকায় ঘুরতে ঘুরতে হ্রদের মাঝখানের ছোট একটা জায়গা হাতছানি দেবে। তার নাম মায়া দ্বীপ। সেখানে চোখে পড়ে তিনটি গোলঘর। গোলঘরে বসলে পাহাড়ের সবুজ অন্ধকারের রহস্যে ডুবে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।

চাম্বি হ্রদের জন্ম যেভাবে

তবে আজ থেকে ছয় বছর আগেও এই হ্রদের অস্তিত্ব ছিল না। এটি ছিল একটি পাহাড়ি ছড়া। চাম্বি হ্রদের কৃষি, মৎস্য ও পর্যটন উন্নয়নবিষয়ক সামগ্রিক কাজ পরিচালনা করে চাম্বি খাল পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লিমিটেড। সমিতির প্রায় ৭০০ সদস্যের সবাই কৃষক এবং রাবার ড্যামের উপকারভোগী। সমবায় সমিতি সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালে রাবার ড্যাম প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে এলজিইডি ব্যয় করে ৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা। কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর ২০১৯ সাল থেকে এটিকে ঘিরে পর্যটনের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখন থেকে প্রতিবছর দেশি-বিদেশি পর্যটকেরা চাম্বি হ্রদে ঘুরতে আসেন। ছুটির দিনগুলোয় হ্রদে দর্শনার্থীদের ভিড় বেড়ে যায় কয়েকগুণ। চাম্বি হ্রদে ঘুরতে মাত্র ২০ টাকা দিয়ে টিকিট কাটতে হয়। হ্রদটিকে এখন মৎস্য প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে। শৌখিন মৎস্য শিকারিরা এখানে টিকিট কেটে মাছ শিকার করতে পারেন।

চাম্বি খাল পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির সভাপতি মাস্টার মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘চাম্বি রাবার ড্যাম স্থাপনের ফলে এ অঞ্চলের কৃষির ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তনের পাশাপাশি পর্যটনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। সমিতির সদস্যদের অর্থায়নে পর্যটন খাতে আমরা এ পর্যন্ত ৫৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছি। পর্যটকদের রাত্রিযাপনের জন্য প্রাথমিকভাবে পাঁচটি কটেজ, সুইমিংপুল, ওয়াটার রাইড, খেলার মাঠ, উন্নত রেস্টুরেন্ট করার পরিকল্পনা আছে।’

চাম্বি হ্রদে নৌকা নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে দেখা যাবে তিন দিকের সবুজ পাহাড়ি অরণ্য নুয়ে পড়ে মুখ দেখছে কাচ স্বচ্ছ জলে। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

যা দেখবেন, যা আছে

পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি, মৎস্য ও পর্যটন খাতের উন্নয়নে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের একটি প্রকল্পের অধীনে চাম্বিতে রাবার ড্যাম বসিয়ে এই হ্রদের সৃষ্টি করা হয়। এর ফলে শুকনো মৌসুমে চাষাবাদের অনুপযোগী প্রায় ৫০০ হেক্টর জমি চাষের আওতায় এসেছে। লাভবান হয়েছেন সাত শতাধিক কৃষক। কৃষি ও মৎস্য উন্নয়নের পাশাপাশি পুরো এলাকাটি সৌন্দর্যের এক অনুপম উদাহরণ হয়ে উঠেছে। ভ্রমণপিপাসু মানুষের জন্য তৈরি হয়েছে নতুন একটি জায়গা।

চাম্বি ছড়ার ওপর যেখানে ২০ মিটার দৈর্ঘ্যের রাবার ড্যাম দেওয়া হয়েছে, তার ওপর রয়েছে একটি পদচারী সেতু। সেতুর ওপর দাঁড়ালে উজানে প্রায় দুই কিলোমিটার বিস্তৃত হ্রদের পানিতে চোখ জুড়িয়ে যায়। চাম্বি হ্রদে রয়েছে তিনটি কৃত্রিম পানির ফোয়ারা, পাঁচটি বিভিন্ন পাখির ভাস্কর্য ও সাতটি প্রাণীর ভাস্কর্য। ভ্রমণের জন্য রয়েছে একটি স্পিডবোট, দুটি প্যাডেল বোট, একটি লাইফ বোট, তিনটি নৌকা। স্পিডবোটে করে যাওয়া যায় চাম্বির উৎসের দিকে। তবে উজানের দিকে যাওয়া কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, হ্রদের তিন দিকে পাহাড়ি বনভূমিতে রয়েছে হাতির চলাচল। একটু দূরে রয়েছে হাতির প্রাকৃতিক প্রজননকেন্দ্র। হরিণ ও বানরেরও দেখা মেলে।

সম্প্রতি ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে ফ্যামিলি ট্রেন। পর্যটকদের জন্য চালু করা হয়েছে ‘শুধু আমরাই’ নামে একটি রেস্টুরেন্ট। অতিথিদের অবকাশের জন্য রয়েছে বিশ্রামাগার। রয়েছে মনোরম পিকনিক স্পটও। বর্তমানে ‘আজব গুহা’ নামে একটি স্থাপনার নির্মাণকাজ চলছে। ওই গুহায় আবহমান গ্রামবাংলার মানুষের জীবন, শিল্প, সংস্কৃতি যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। শিগগিরই এটির উদ্বোধন করা হবে।

লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইনামুল হাছান প্রথম আলোকে জানান, চুনতি পানত্রিশা রাবার ড্যাম প্রকল্প সম্ভাবনাময় পর্যটনকেন্দ্র। এটি এলাকার কৃষি ও মৎস্য খাতেও দারুণ অবদান রাখছে। পর্যটকদের আকর্ষণ আরও বাড়াতে হ্রদের সৌন্দর্যবর্ধনে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও উদ্যোগ নেওয়া হবে।

চাম্বি হ্রদে যাওয়ার পথটিও কিন্তু মুগ্ধ করবে আগতদের
ছবি: প্রথম আলো

যেভাবে যাবেন

কক্সবাজারে যাওয়া–আসার পথেই কয়েক ঘণ্টার জন্য বিরতি নিয়ে ভ্রমণপিপাসু ব্যক্তিরা বেড়াতে পারেন চাম্বি হ্রদে। উপজেলা সদর থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ধরে ৭ কিলোমিটার দক্ষিণে চুনতি শাহ সাহেব গেট। সেখান থেকে ইসহাক মিয়া সড়ক দিয়ে পূর্বে বা দক্ষিণে ১২ কিলোমিটার গেলেই চাম্বি হ্রদ। যাওয়ার পথের দুই পাশে দিগন্তপ্রসারী ধানখেত ও শীতকালীন শাকসবজি, গবাদিপশুর চারণভূমি, মানুষের ঘরবাড়ি, পুরোনো সব গাছপালা এবং ঢোলকলমি ফুলের দৃশ্য মন কেড়ে নেবে। চাম্বি হ্রদে এ সময় আসতে শুরু করে অতিথি পাখির ঝাঁক। আর কদিন পরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শুরু হবে বার্ষিক ছুটি। গরমের চোখরাঙানি আর বৃষ্টির ভোগান্তি নেই বলে এখানে ভ্রমণের জন্য শীতকেই আদর্শ মৌসুম ধরা হয়।