বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার চেষ্টা, পরে হাসপাতালে মৃত্যু
বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার বাড়িতে ‘আত্মহত্যার চেষ্টা’ করা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। শুক্রবার সকালে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওই ছাত্রী মারা যান।
বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মাজেদুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। শিক্ষার্থীরা জানান, এ নিয়ে চলতি বছরের আট মাসে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করলেন। এ ছাড়া গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অন্তত ১০ শিক্ষার্থী আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। তবে সহপাঠীদের চেষ্টায় তা ব্যর্থ হয়।
অর্পণা দাস নামের ওই শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার সোনামুখী গ্রামের শ্যামল দাসের মেয়ে। লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা এসআই মাজেদুল পরিবারের সদস্যদের বরাত দিয়ে জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টার দিকে মেহেন্দীগঞ্জের গ্রামের নিজ বাড়িতে ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে ওই ছাত্রী আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। পরিবারের সদস্যরা টের পেয়ে তাৎক্ষণিক তাঁকে উদ্ধার করে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এনে ভর্তি করেন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার সকালে তিনি মারা যান। হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার আবুল কালাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
মেহেন্দীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াসিনুল হক বলেন, ওই ছাত্রীর পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় কেউ কিছু জানায়নি। বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি ফোন করে বিষয়টি তাঁদের জানিয়েছেন। পরে ওই ছাত্রীর বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাটি মেট্রোপলিটন পুলিশের বন্দর থানার আওতায় পড়েছে। থানার ওসি বিপ্লব কুমার মিস্ত্রি বলেন, ঠিক কী কারণে ওই ছাত্রী আত্মহত্যা করেছেন, পরিবার জানাতে পারেনি। পরিবারের কোনো অভিযোগ না থাকায় ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে।
উদ্বিগ্ন শিক্ষার্থী-প্রশাসন
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চলতি বছরের আট মাসে এ নিয়ে চার শিক্ষার্থী আত্মহনন করেছেন। এ নিয়ে অভিভাবক ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে উদ্বেগ বাড়ছে।
শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্র জানায়, গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অন্তত ১০ শিক্ষার্থী আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। তবে সহপাঠীদের চেষ্টায় তা ব্যর্থ হয়। তাঁদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু হলে দুজন ছাত্র, শেরেবাংলা হলে তিনজন, শেখ হাসিনা হলে একজন, রূপাতলী হাউজিং এলাকায় নিজ নিজ মেসে দুজন ছাত্র ও এক ছাত্রী, শেখ হাসিনা হলের সামনে এক ছাত্র এবং ঝালকাঠিতে নিজ বাসভবনে একজন ছাত্র আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।
শিক্ষার্থীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নানা কারণে মানসিক জটিলতা, সম্পর্কের টানাপোড়েন, উদ্বিগ্নতা-নিঃসঙ্গতায় থাকেন। এ জন্য গত মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মেন্টাল হেলথ কাউন্সেলিং অ্যান্ড গাইডেনস সেন্টার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালুর উদ্যোগ নিলে তা প্রাতিষ্ঠানিকতা পায়নি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন, সমস্যার প্রতিকার-পরিচর্যা এবং কাউন্সেলিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন মনোরোগবিশেষজ্ঞ নিয়োগের দাবি করে এলেও সে দাবি পূরণ হয়নি।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরেই একজন মনোরোগবিশেষজ্ঞ নিয়োগের জন্য দাবি জানাচ্ছি। কিন্তু আজও সে দাবি পূরণ হয়নি। মাঝেমধ্যে মানসিক রোগ বিষয়ে কিছু সেমিনার হলেও সেগুলো খুব কাজে আসছে না। আবার মানসিক সমস্যা নিয়ে অনেক সময় শিক্ষার্থীরা লোকলজ্জায় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে বা কাউন্সেলিং করাতে চান না। ফলে সমস্যাটি প্রকট হচ্ছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও সাবেক প্রক্টর মো. খোরশেদ আলম বলেন, ‘আমরা আরও এক শিক্ষার্থীকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে হারালাম। এভাবে একজন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীর অকালমৃত্যু শুধু পরিবার নয়, দেশের জন্য বিরাট ক্ষতি। এই প্রবণতা রোধে এখন জাতীয়ভাবে ভাবনাচিন্তা করে বড় ধরনের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।’
মো. খোরশেদ আলম আরও বলেন, দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা, ক্যারিয়ার, প্রত্যাশা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একধরনের শূন্যতা, হতাশা দেখা যাচ্ছে। এ জন্য তাঁদের মানসিক শক্তি বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন মনোরোগবিশেষজ্ঞের পদ স্থায়ীভাবে তৈরির জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কাছে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু সে ব্যাপারে সাড়া মেলেনি। এখন এ ব্যাপারে নতুন করে ভাবা দরকার।