‘মানুষ ডরে রাস্তাঘাটে বাইর হয় না, হেললাইগ্যা ইনকামও নাই’
প্রায় ১২ বছর ধরে গাজীপুর নগরে রিকশা চালান পঞ্চাশোর্ধ্ব মো. দেলোয়ার হোসেন। রিকশা চালিয়ে যে আয়, তা দিয়ে কোনোরকমে টেনেটুনে সংসার চলে তাঁর। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সরকার ঘোষিত কারফিউ ও নানা পদক্ষেপের কারণে ১৩ দিন ধরে তাঁর আয় কমে দাঁড়িয়েছে অর্ধেকে, কখনোবা শূন্যের কোঠায়। এতে পরিবার নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তিনি। চলতে হচ্ছে ধারদেনা করে। সংসার খরচ জোগাতে দিনরাত রিকশা নিয়ে ছুটছেন নগরের অলিগলি।
গতকাল বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে দেলোয়ার হোসেনকে পাওয়া গেল নগরের জয়দেবপুর রেলস্টেশনের সামনে। ট্রেন চলাচল বন্ধ ১৮ জুলাই থেকে। স্টেশনের মূল ফটকে তালা। কোনো যাত্রী নেই। নেই মানুষের তেমন আনাগোনা। এর মধ্যেই দেলোয়ার যাত্রীর আশায় তাঁর ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন স্টেশনের সামনের সড়কে। অনেকক্ষণ পরপর দু-একজন পথচারী আসতে দেখলেই ছুটে যাচ্ছেন তাঁদের কাছে।
দীর্ঘক্ষণ হাঁকডাক করেও কোনো যাত্রী পেলেন না দেলোয়ার। একপর্যায়ে কিছুটা ক্লান্তচিত্তে বসলেন স্টেশনের সামনের একটি চায়ের দোকানে। তিনি বলছিলেন, ‘আমাগোর ইনকামের একটা বড় জায়গা হইলো এই রেলস্টেশন। সারা দিন যা যাত্রী পাই, তার প্রায় সবই এখানকার। কিন্তু ১২–১৩ দিন ধইরা ট্রেন চলে না। কোনো যাত্রী নাই। এ কারণে আমাগোর ইনকাম বন্ধ হইয়্যা পথে বসার দশা হইসে। ট্যাকার অভাবে ঘরভাড়া দিতে পারতাছি না, বাজারঘাটও নাই। হেললাইগ্যা বাধ্য হইয়্যা রাইতেও রিকশা নিয়া বাইর হইসি। কিন্তু তা–ও ইনকাম নাই।’
কথা প্রসঙ্গে দেলোয়ার বলেন, তাঁর বাসা নগরের সামন্তপুর এলাকায়। স্ত্রী ও তিন মেয়ে নিয়ে চার সদস্যের পরিবার তাঁর। মেয়েরা লেখাপড়া করেন। তাঁর একার আয়েই চলে পুরো পরিবার। সংসারের খরচ জোগাতে কখনো দিনে, কখনোবা রাত জেগে রিকশা চালান তিনি। তবে কোনো কারণে যাত্রী কম হলে বা সংসার খরচে ঘাটতি পড়লে রাত–দিন দুই বেলাতেই রিকশা চালান। গত ১৮ জুলাই থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত ও পরবর্তী পদক্ষেপে সড়কে যাত্রী কমে গেছে। এ কারণে তিনি আগের মতো উপার্জন করতে পারছেন না। ঘরভাড়া, মেয়েদের লেখাপড়া বা সংসার খরচ নিয়ে চরম বেকায়দায় পড়েছেন। তাই বাধ্য হয়ে দিনের পাশাপাশি রাতেও রিকশা চালাতে হচ্ছে তাঁকে।
আগে দিনে রিকশা চালিয়ে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা আয় হতো দেলোয়ারের। এর মধ্যে রিকশাভাড়া বাবদ মহাজনকে দিতে হতো ৫০০ টাকা। বাকি ২০০–৩০০ টাকা নিয়ে ঘরে যেতে পারতেন। এখন মহাজনকে জমা দেওয়ার টাকাও ওঠে না।
দেলোয়ারের সঙ্গে কথা বলার সময় পাশ থেকে এগিয়ে আসেন আরেক রিকশাচালক মো. আকবর আলী। তিনি সাধারণত রিকশা চালান রাতে। দিনে অন্য কাজ করেন। কিছুদিন ধরে তাঁর আয়ও কমে গেছে। তিনি বলেন, ‘রাস্তাঘাটের অবস্থা খারাপ দেইখ্যা আমার বউ-বাচ্চা ঘর থেইক্যা বাইর হতে দেয় নাই। টানা পাঁচ দিন বইস্যা ছিলাম। কিন্তু বইস্যা থাইক্যা আর সংসার চলে না। হেললাইগ্যা ঝুঁকি নিয়াই আবার রিকশা নিয়া বাইর হইসি। মানুষ ডরে রাস্তাঘাটে বাইর হয় না, হেললাইগ্যা ইনকামও কম।’