দেশকেই যারা সম্মান করে না, তারা কার কাছে নির্বাচনে ভোট দাবি করবে

সিলেট জেলা জামায়াতে ইসলামীর কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান। আজ শুক্রবার সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা মাঠেছবি: প্রথম আলো

‘দেশে-বিদেশে অনেকে জিজ্ঞেস করে, আগামী নির্বাচনে তারা কি আসবে? আমি বলি, দেশকেই যারা সম্মান করে না, তারা কার কাছে এসে নির্বাচনে ভোট দাবি করবে? যারা জনগণের টাকায় কেনা অস্ত্র এবং গুলি জনগণের বুকের ওপর চাপিয়ে দেয় ক্ষমতায় থাকার জন্য, তারা কার কাছে ভোট চাইবে?’

আজ শুক্রবার সকাল ১০টায় সিলেট নগরের চৌহাট্টা এলাকার সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে জামায়াতের কর্মী সম্মেলনে আওয়ামী লীগের উদ্দেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান এসব কথা বলেন। দীর্ঘ দেড় যুগ পর এ সম্মেলনের আয়োজন করে সিলেট জেলা জামায়াত।  

শফিকুর রহমান আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে আরও বলেন, ‘যারা নিরীহ জনগণকে খুন করেছে, তাঁদের পরিবারের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করুক, তাঁরা এ ধরনের রাজনীতি আর চায় কি না। এ ধরনের আগ্রাসী দলকে আর রাজনীতিতে দেখতে চায় কি না, তাঁদের কাছে গিয়ে জানুক। আমাদের কাছে জানার দরকার নেই, আমরা তো বেঁচে আছি। পঙ্গুত্বের কষ্ট নিয়ে যাঁরা বেঁচে আছেন, হাসপাতালের বেডে যাঁরা প্যারালাইজড হয়ে আছেন, তাঁদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করুক, তাঁরা কী চান?’

জামায়াত বৈষম্যহীন বাংলাদেশ নিশ্চিত করতে চায় বলে মন্তব্য করেছেন দলের আমির শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এমন বাংলাদেশ আমরা গড়তে চাই, যে বাংলাদেশে মসজিদ, মন্দির, চার্চ, প্যাগোডা, মঠ কোনো জায়গায় নিরাপত্তার জন্য পাহারা বসানোর প্রয়োজন হবে না। বরং ঘরে-বাইরে নিজেদের ধর্মীয় কাজে, সামাজিক কাজে, পেশাগত কাজে সব জায়গায় একজন নাগরিক পূর্ণ স্বাধীনতা, মর্যাদা ও নিরাপত্তা ভোগ করবে। এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষদের সমান মর্যাদা ও নিরাপত্তা দেওয়া হবে।’

শফিকুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী স্বপ্নের রাষ্ট্র যদি গড়ার সুযোগ পায়, আল্লাহ কোরআনের ভিত্তিতে সেই রাষ্ট্রে পুরুষের পাশাপাশি আমাদের মা-বোনেরা, আমাদের মেয়েরা অত্যন্ত মর্যাদা, গর্ব এবং ইজ্জতের সঙ্গে তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করবেন, তাঁরা পাবেন পূর্ণ নিরাপত্তা।’

জামায়াতের আমির বলেন, ‘ধর্মের কারণে কোনো মানুষ তাঁর যোগ্য ভূমিকা পালন থেকে বঞ্চিত হবে না। তবে দুঃখের বিষয়, গত সাড়ে ১৫ বছর যাঁদের দাড়ি আছে, যে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় নামাজে যায়, তাঁকে অপদস্ত, কোণঠাসা এবং তাঁর অধিকার থেকে তাঁকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এই অপকর্ম আর বাংলাদেশে চলতে দেওয়া হবে না।’

শফিকুর রহমান বাংলাদেশের মানুষ এখন শান্তিতে আছেন বলে বক্তব্যে বলেছেন। তিনি বলেন, ‘এই শান্তিকে বিঘ্নিত করার জন্য দফায় দফায় চেষ্টা করা হচ্ছে। ইনশা আল্লাহ আমরা আশাবাদী, একটা ঐক্যবদ্ধ জাতি সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে সামনের দিকে এগিয়ে যাব। আমরা এমন একটা বাংলাদেশ গড়তে চাই, আমাদের সন্তানদের আশা পূরণের উপযুক্ত বাংলাদেশ। তাদের প্রধান স্লোগান ছিল, উই ওয়ান্ট জাস্টিজ। আমরা বৈষম্যহীন ন্যায়বিচারপূর্ণ একটা সমাজ চাই। আমরা তাঁদের কথা দিচ্ছি, আল্লাহ তাআলার সাহায্য এবং জনগণের ভালোবাসা পেলে আমরা সেই সমাজটি বাংলাদেশ এবং জাতিকে উপহার দেব। আমরা কথা দিচ্ছি, আমাদের হাত দিয়ে কোনো চাঁদাবাজি হবে না এবং চাঁদাবাজি বরদাশতও করব না। আমরা কথা দিচ্ছি, বাংলাদেশের এক ইঞ্চি মাটির ওপরও কারও কোনো দখলবাজি চলবে না এবং চলতে দেবও না। আমরা কথা দিচ্ছি, সরকারি, আধাসরকারি, বেসরকারি অফিসে বসে কেউ ঘুষ খাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করবে না এবং দুঃসাহস দেখাবে না।’

জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের প্রসঙ্গ টেনে শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমাদের মাথার তাজ শীর্ষ ১১ জন কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীলকে তাঁরা খুন করেছে। কাউকে দিয়েছে ফাঁসি, আর কাউকে জেলের ভেতরে তারা মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। একজন কেবল আমাদের মধ্যে এখনো বেঁচে আছেন কষ্ট, যন্ত্রণা, দুঃখ, ব্যথা নিয়ে। তিনি হচ্ছেন আমাদের প্রিয় সম্মানিত ভাই, তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ কে এম আজহারুল ইসলাম। আমাদের বিশ্বাস ছিল, আল্লাহ তাঁর এই বান্দাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, বাংলাদেশকে ভালো কিছু দেখানোর জন্য, নতুন কিছু দেখানোর জন্য। আমরা সেই নতুন ও ভালো কিছু দেখার প্রস্তুতি নিয়েছি এবং আদালতের ন্যূনতম বিচার পেলে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে আপনাদের বুকে ফিরে আসবেন ইনশা আল্লাহ।’

বাংলাদেশ ও জামায়াত নিয়ে দেশি-বিদেশি অনেক ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত হয়েছে বলে অভিযোগ করেন শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘তারা চেয়েছিল রক্তের পদ্মা, গঙ্গা, যমুনা, সুরমা বয়ে যাক। এটা না হওয়ার কারণে এখন তারা অশান্তিতে আছে। তারা দেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রপাগান্ডা করছে। দেশ থেকে করছে, বিদেশ থেকে করছে। দেশের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করার জন্য মিথ্যা গল্প সাজিয়ে বিদেশি বন্ধুদের তারা বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। অবশ্য পদে পদে তাদের সব ষড়যন্ত্র-শয়তানি ধরা পড়ে গেছে। মানুষ এখন ঘুমে নয়, সজাগ।’

শফিকুর রহমান আরও বলেন, ‘তারা দেশের ইতিবাচক পরিবর্তনকে, গণ–অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য দফায় দফায় অনেক কাণ্ড ঘটিয়েছে। তারা জুডিশিয়াল ক্যু করতে চেয়েছিল, তারা আনসার-কাণ্ড ঘটিয়ে ক্যু করতে চেয়েছিল, তারা চাকরি-কাণ্ড নিয়ে ক্যু করতে চেয়েছিল। এরপর তারা ইসকন-কাণ্ড নিয়ে নামল—আল্লাহ ওইটাও ব্যর্থ করে দিয়েছে। শেষমেশ ইসকনের লোকেরা নির্দয়ভাবে একজন আইনজীবীকে খুন করল প্রকাশ্য দিবালোকে, ত্রিফলা দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে। এই খুন করে মূলত এ দেশের দেশপ্রেমিক মানুষ, বিশেষ করে মুসলমানদের উসকানি দেওয়া হয়েছিল। আমরা তখন সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের অনুরোধ করেছিলাম, শান্ত থাকুন এবং মাঠ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখুন। আলহামদুলিল্লাহ—দুটিই হয়েছে। তাঁরা শান্তও থেকেছে, মাঠও নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। এখন গর্তে ঢুকেছে খুনিরা, কিন্তু তাদের বিদেশ থেকে বাতাস দেওয়া হচ্ছে।’

জামায়াতের আমির হিন্দুধর্মাবলম্বীদের প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা ধন্যবাদ জানাই, এই দেশের, বিশেষ করে হিন্দুধর্মাবলম্বী ভাইদের। তাঁরা তাঁদের বিবেকের জায়গা থেকে প্রতিবাদ করে বলছেন, “আমরা শান্তিতে আছি, তোমরা আমাদের শান্তির ওপর আঘাত দিয়ো না। আমাদের শান্তিতে থাকতে দাও।’ ভারতকে তাঁরা বলেছেন, “আমাদের নিয়ে আর খেলো না। বহু খেলা তোমরা খেলেছ, এখন তোমরা শান্ত হও। আমরা এই দেশের ধর্মবর্ণ–নির্বিশেষে ভালো আছি, ভালো থাকতে চাই।”’

দেশের সব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ রয়েছে জানিয়ে শফিকুর রহমান বলেন, ‘অতিসম্প্রতি ইসকনের ঘটনা ঘটার পরে আমাদের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা দাওয়াত দিয়েছিলেন সব ধরনের সংগঠনকে। ডান, বাম, ইসলামি, মধ্যম—সবাইকে। বাংলাদেশের ৫৩ বছর চলার জীবনে প্রথমবারের মতো সব ঘরানার রাজনৈতিক নেতারা একসঙ্গে বসে হাত তুলে অঙ্গীকার করেছেন, দেশ ও জনগণের স্বার্থ রক্ষায়, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আমরা সব এক। আমরা কোনো অপশক্তির কাছে মাথা নত করব না।’

সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন সিলেট জেলা জামায়াতের আমির মাওলানা হাবিবুর রহমান। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, ঢাকা মহানগর উত্তরের আমির মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ফজলুর রহমান ও সিলেট মহানগর জামায়াতের আমির মুহাম্মদ ফখরুল ইসলাম।

সভা যৌথভাবে সঞ্চালনা করেন সিলেট জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি জয়নাল আবেদীন, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল নজরুল ইসলাম ও মাওলানা মাশুক আহমদ।