সাড়ে পাঁচ লাখ ইঁদুর মেরেছেন সোনাগাজীর মো. হোসেন
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে প্রতিবছর দেশে ইঁদুরের কারণে গড়ে ৫০০ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। এই ফসল ১ বছরে প্রায় ৫০ লাখ মানুষের খাবারের জোগান দিতে পারত। নিজের জমিতে ইঁদুরের উৎপাত দেখে তরুণ বয়সেই বিষয়টি উপলব্ধি করেছিলেন ফেনীর সোনাগাজীর কৃষক মো. হোসেন আহম্মদ। পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে ফাঁদ পেতে তিনি ইঁদুর ধরেন। প্রতিবছর ইঁদুর মেরে পুরস্কারও জেতেন তিনি। এর জন্য পেয়েছেন অর্ধশত কৃষি পুরস্কারও।
ইঁদুর মেরে পুরস্কার পাওয়া কিন্তু সহজ বিষয় নয়। ইঁদুর মারার জন্য হোসেন ব্যবহার করেন নিজস্ব কৌশল। প্রথমে বাঁশের কঞ্চি ও তার দিয়ে তৈরি করেন ফাঁদ। ফাঁদে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে শুঁটকি ও রুটি। সেই শুঁটকি ও রুটি খেতে এসে ইঁদুর ফাঁদে আটকা পড়ে। পরে বাঁশের ভেতর থেকে বের করে ইঁদুরগুলোকে মেরে ফেলেন।
সোনাগাজী উপজেলার মঙ্গলকান্দি ইউনিয়নের দশপাইয়া এলাকার বাসিন্দা মো. হোসেন আহম্মদ। ইঁদুর মারছেন ২০ বছর বয়স থেকে। চলতি বছর তিনি ১২ হাজার ৫৮৯টি ইঁদুর মেরে জেলা ও উপজেলায় প্রথম এবং চট্টগ্রাম বিভাগে তিনি দ্বিতীয় হয়েছেন। এভাবে বিগত ৬০ বছর ধরে তিনি প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষাধিক ইঁদুর মেরেছেন।
প্রত্যেক বছর কৃষি বিভাগ থেকে অক্টোবর থেকে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত মাসব্যাপী ফসল রক্ষায় ইঁদুর নিধন অভিযান পরিচালিত হয়। উপজেলা, জেলা ও আঞ্চলিক পর্যায় থেকে দেশ সেরা ইঁদুরশিকারিদের পুরস্কৃত করা হয়।
উপজেলা কৃষি বিভাগ জানায়, ইঁদুর ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে। ইঁদুর নিজে যা খায় তার চেয়ে ১০ গুণ খাদ্য নষ্ট করে। এ ছাড়া ইঁদুর থেকে ৬০ ধরনের রোগ ছড়ায়। মূলত এ ক্ষতির পরিমাণ উপলব্ধি করেই ইঁদুর শিকারে উদ্বুদ্ধ হন কৃষক হোসেন আহম্মদ। হোসেন আহম্মদ পেশায় একজন কৃষক হলেও এলাকায় সবাই তাকে ইঁদুরশিকারি হিসেবে এক নামে চেনেন। ১৯৬৩ সাল থেকে এই কাজ করে আসছেন তিনি।
ইঁদুর মেরে তিনি উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় কৃষি বিভাগ থেকে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার।
ইঁদুর শিকার হোসেন আহম্মদের পেশা না হলেও নিয়মিত কাজগুলোর একটি। জমি চাষের পাশাপাশি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের জনগণকে তিনি ঈঁদুর মারার কৌশল শেখান। ঘরবাড়ি, দোকানপাট, হাঁস-মুরগির খামার কীভাবে ইঁদুর মুক্ত করা যায় দেন সে পরামর্শও। কৃষি বিভাগের বিভিন্ন সভা-সেমিনার ও প্রশিক্ষণেও তাঁর ডাক পড়ে।
ইঁদুরশিকারি হোসেন আহম্মদ বলেন, ইঁদুর হচ্ছে ফসল ও কৃষকের প্রধান শত্রু। কৃষি কাজ করতে গিয়ে তিনি এটি বুঝতে পেরেছেন। এরপর থেকে তিনি নিজস্ব কৌশলে ইঁদুর মারা শুরু করেন।
হোসেন আহম্মদ বলেন, তিনি চলতি বছর ১২ হাজার ৫৮৯টি ইঁদুর মেরে লেজ সংরক্ষণ করেছেন। তাঁর উদ্দেশ্য ইঁদুর নিধনে জাতীয় পর্যায়ে অবদান রাখা। ইঁদুর নিধনে অবদান রাখার জন্য তিনি ১৯৬৩ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত নিয়মিত উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় পর্যায়ে অর্ধশতাধিক পুরস্কার লাভ করেছেন।
ইঁদুর মেরে উপহাসের পাত্র
ইঁদুর মেরে ফসল রক্ষার কাজ করে গেলেও হোসেনকে তাঁর এলাকায় অনেকের কাছে উপহাসের পাত্র হতে হয়েছে। অনেকেই তাঁকে ‘ইঁদুর মিয়া’ বলেও সম্বোধন করেন। তবে এসব একেবারেই গায়ে মাখেন না হোসেন। তার কথা, লোকে কী বলে তা শোনার ‘টাইম নাই’।
উপজেলার মঙ্গলকান্দি ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আজিজ উল্যাহ বলেন, ‘হোসেন আহম্মদ আমাদের সবার পরিচিত মুখ। সবাই তাঁকে একনামে চেনে। ইঁদুর নিধনে অসংখ্য পুরস্কার পেয়ে তিনি আমাদের সবার মুখ উজ্জ্বল করেছেন। অথচ ইঁদুর নিধনের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে গিয়ে এলাকাবাসী ও পরিবারের সদস্যদের উপহাসের পাত্র হয়ে গেছেন তিনি। আমরা কাজের মূল্যায়ন করতে জানি না। যে লোকটি ইঁদুর মারার কারণে সবার উপকার করে যাচ্ছেন, অনেকেই তাঁকে নানা ব্যঙ্গাত্মক নাম দিয়ে ডাকেন।’
জানতে চাইলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাইন উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশে ইঁদুর প্রায় ৫০-৫৪ লাখ লোকের এক বছরের খাবার নষ্ট করে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮১ হাজার ৬৯৪টি ইঁদুর নিধন করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে সোনাগাজী উপজেলা কৃষি অফিস প্রথম স্থান পুরস্কার লাভ করেছে।
প্রতিবছর সরকারিভাবে ইঁদুর নিধন অভিযান পরিচালিত হয়। ইঁদুর নিধনের লক্ষ্যে কৃষি বিভাগের কর্মী, কৃষক-কিষানি ছাত্রছাত্রীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মধ্যে কৃষক হোসেন আহম্মদ অসংখ্যবার শ্রেষ্ঠ ইঁদুরশিকারির পুরস্কার পেয়েছেন। আশা করি হোসেন আহম্মদ ভবিষ্যতে ইঁদুর নিধনে জাতীয় পুরস্কার লাভ করবেন।’