মলিনমুখে আইলশার বাজারে এসেছেন মাছ কিনতে। কিন্তু বনিবনা হচ্ছিল না৷ চার দিন আগেও মাঠে ছিল তার সোনালি ফসল। কিন্তু বানের জলে তলিয়ে গেছে তাঁর ৩৫ কাঠা জমির আমন ধান, মাছের পুকুর। বন্যায় ক্ষতির মুখে তিনি।
স্থানীয়ভাবে আইলশার বাজার নামে পরিচিত। তবে এর প্রকৃত নাম আলিশাহর বাজার। আলি নামে এক ব্যক্তি তিন দশক আগে বাজারটি প্রতিষ্ঠা করেন। বাজারটির অবস্থান ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার নড়াইল ইউনিয়নের বাঘমার গ্রামে।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, আইলশার বাজারের চারদিকে পানি আর পানি। বন্যার পানিতে ধরা মাছ বাজারে বিক্রি করতে এসেছেন অনেকে। কম দামে মাছ পাবেন—এ আশায় ক্রেতারও আনাগোনা আছে। যদিও আগে এখানে প্রতিদিন মাছের বাজার বসত না।
আইলশার বাজারে মাছ কিনতে এসেছেন উপজেলার নিশ্চিন্তপুর গ্রামের আবুল কাশেম (৬০)। বিক্রেতার সঙ্গে তাঁর দরদাম মিলছে না; তিনি মাছও কিনতে পারছেন না। একপর্যায়ে তাঁর সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। আবুল কাশেম জানালেন, গত শনিবার থেকে বন্যায় সব তলিয়ে রয়েছে। ৩৫ কাঠা জমিতে ধান চাষ করেছিলেন। সব পানির নিচে। এবার ঘরে ফসল উঠবে না। দুটি পুকুরে মাছ ছিল; বছরজুড়ে মাছ খেতাম। সেই মাছও ভেসে গেছে। ১০ জনের সংসার চলবে কীভাবে? বন্যার পানিতে অনেকেই মাছ ধরছেন। দাম কম হওয়ায় বাজারে মাছ কিনতে এসেছেন।
গত শুক্রবার পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিতে বন্যার কবলে পড়েছেন হালুয়াঘাটের ১২টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার বাসিন্দারা। উপজেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, আজও পানিবন্দী আছে অন্তত ৭৫ হাজার মানুষ।
উপজেলার বটগাছিয়া কান্দা গ্রামের নাজমুল হোসেন (৪২) কৃষিকাজ করে সংসার চালান। ২০ কাঠা জমিতে ধান চাষ করেছিলেন। বন্যায় ধানের খেত তলিয়ে গেছে। কিছু টাকি ও কই একটি বালতিতে নিয়ে বিক্রি করতে বসেছেন আইলশা বাজারে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বন্যায় ধান নিছে। তাই মাছ লইয়্যা বাজার আইছি। পকেট খরচটা অন্তত লাগব। তাই আইজকাই মাছ লইয়্যা আইছি।’
মাহফুজ মিয়া (১৯) কৃষিশ্রমিকের কাজ করেন; তাঁর বাড়ি বটগাছিয়া কান্দা গ্রামে। বন্যার পর গত শনিবার থেকে মাছ ধরছেন। বিকেল পৌনে চারটার দিকে শোল মাছ নিয়ে ট্রলার থেকে নামেন তিনি। তাঁর মাছে নজর পড়ে বাজারের ক্রেতাদের। দরদাম শুরু হয়ে যায় মুহূর্তে। মাহফুজ মিয়া বলেন, ‘চাইর দিকে পানি, কামকাজ নাই। মাছ ধইরাই সময় কাটাই।’
আতুয়াজঙ্গল গ্রামের আবদুস সোবহানও (৬৬) এসেছেন মাছ কিনতে। হাতে ব্যাগ। তাঁর ৭০ কাঠা জমির আমন ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। ১৪ কাঠা জমির মাছের খামার পানিতে ভেসে গেছে। তিনি বলেন, ‘এবারের মতো বন্যা এ জীবনে আর দেখিনি। বন্যায় সর্বস্বান্ত করে দিল।’
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিন জানান, প্রাথমিক হিসেবে হালুয়াঘাট উপজেলায় ৬ হাজার ১৫০টি পুকুর তলিয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অন্তত চার হাজার কৃষক। মৎস্য খাতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলায় ১১ হাজার ১০০ হেক্টর জমির রোপা আমন ও ৭৫ হেক্টর জমির সবজি তলিয়ে গেছে। এতে অন্তত ৩০ হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বন্যার পানি দ্রুত সরে না গেলে ক্ষতি আরও বাড়বে।