দুঃসময়ের ‘পানিবন্ধু’
দীর্ঘদিন বৃষ্টির দেখা নেই। তাপপ্রবাহে চারদিক পুড়ে খাক হওয়ার জো। পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। গভীর নলকূপেও পানির তল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়িতে বাড়িতে পানির জন্য হাহাকার। ব্যতিক্রম কেবল একটি বাড়ি। সে বাড়ির গভীর নলকূপটি সচল। পানি উঠছে। এবাড়ি-ওবাড়ি হয়ে খবর চাউর হয়ে গেল, আশুতোষ মজুমদারের নলকূপে পানি উঠছে।
হাঁড়ি-পাতিল, বালতি, কলস, বোতল নিয়ে লোকজন জড়ো হতে লাগলেন আশুতোষের বাড়ির আঙিনায়। কাউকেই হতাশ করলেন না মিষ্টভাষী মানুষটি। হাসিমুখে পানি নিতে দিলেন সবাইকে। প্রতিবেশী, এমনকি আশপাশের পাড়ার মানুষও একে একে সেই কাতারে শামিল হলেন। সবারই পানি চাই। মাসদুয়েক আগে এ ঘটনার শুরু। এরপর আশুতোষের উদার আমন্ত্রণে মানুষের ঢেউ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। দিনরাতে মিলিয়ে তাঁর বাড়িতে এখন দুই থেকে আড়াই শ মানুষের ভিড় রোজ লেগেই থাকে। বৈদ্যুতিক মোটরে গভীর নলকূপ থেকে পানি উঠছে। আর সেই ঠান্ডা পানি নিয়ে যাচ্ছে গ্রামের মানুষ।
জনে জনে সুপেয় পানি বিলাতে গিয়ে অবশ্য নিজের গাঁটের টাকাও খোয়াতে হচ্ছে আশুতোষকে। প্রতি মাসে বাড়তি কয়েক হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল গুনতে হচ্ছে তাঁকে। তবে এতে তাঁর আফসোস নেই। যত দিন মানুষ তাঁর বাড়ি আসবে, তত দিন এভাবে পানি দেওয়া চালিয়ে যেতে চান এই কলেজশিক্ষক। আশুতোষের বাড়ি যশোরের কেশবপুর পৌর শহরের মধুসড়কে। ৩৮ বছর বয়সী আশুতোষ একজন সচ্ছল কৃষক। বেসরকারি একটি কলেজের তিনি প্রভাষকও।
প্রচণ্ড গরমে তৃষ্ণার্ত প্রতিবেশীদের কাছে আশুতোষের পরিচয় এখন ‘বিপদের বন্ধু’।
কেশবপুর পৌর শহরের মধুসড়কের গৃহবধূ নাজনীন নাহার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পৌরসভার সাপ্লাইয়ের পানি খাওয়া যায় না। আমরা নলকূপের পানি খাই। কিন্তু কারও বাড়িতেই পানি ওঠে না। এমন বিপদের সময় আশুতোষ স্যার নিজের বিদ্যুৎ খরচে লোকজনকে ডেকে ডেকে পানি দিচ্ছেন।’
আশুতোষের পানি বিতরণের কথা কেশবপুরের নাগরিক সমাজের সভাপতি আইনজীবী আবু বকর সিদ্দিকীও শুনেছেন। তিনি বলেন, এটি খুবই প্রশংসনীয় একটি উদ্যোগ। এ রকম উদ্যোগ আরও সম্প্রসারিত হওয়া প্রয়োজন।
ব্যতিক্রমী নলকূপ
মধুসড়কের আধকিলোমিটারের মধ্যে কেশবপুর সরকারি পাইলট উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়, বাক্সপট্টি, সাহাপাড়া, কেশবপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজসহ আশপাশের এলাকায় অন্তত ১৫টি গভীর নলকূপ আছে। সেগুলোর একটিতেও পানি উঠছে না বলে জানালেন স্থানীয় লোকজন। পানি উঠছে কেবল মধুসড়কে আশুতোষের নলকূপ থেকে।
তাঁর নলকূপটি কেন ব্যতিক্রম সে ব্যাখ্যা জানা গেল আশুতোষের মুখেই। ২০১৭ সালে বাড়িতে ১ হাজার ২৪০ ফুটের গভীর নলকূপটি তিনি বসান। এক বছর যেতে না যেতেই খরা মৌসুমে তা দিয়ে পানি উঠছিল না। পরে নিচে তিনি একটি সাবমার্সিবল পাম্প বসান। এরপর থেকে দিব্যি পানি উঠছে।
গত এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া তাপপ্রবাহে যশোরের মানুষও দুর্দশায়। যশোর বিমানবন্দর আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, এপ্রিল ও মে মাসে তাপমাত্রার পারদ ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠে। আর কৃষি কার্যালয় বলছে, কেশবপুরে সর্বশেষ গত ১৯ মে ৪৩ দশমিক ৫ মিলিমিটার বৃষ্টির রেকর্ড করা হয়েছে। গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে কেশবপুরে বৃষ্টির দেখা নেই (গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে কিছুটা বৃষ্টি হয়েছে)। সব মিলিয়ে গরমে মানুষের ত্রাহি দশা।
এমন গরমে কেশবপুরে খাবার পানির বড় উৎস নলকূপ। সেই নলকূপেই পানি ওঠা বন্ধ হয়ে গেল। পৌরসভার পাইপলাইনে পানি এলেও লোকে সে পানি খেতে চায় না। গত চৈত্র ও বৈশাখ মাসে সবার বাড়ির নলকূপ যখন ‘শুকিয়ে’ গেল, তখন আশুতোষের নলকূপটি চালু রইল। সেই বৈশাখ মাস থেকে প্রতিদিন কয়েক শ মানুষের মধ্যে পানি বিতরণ করে যাচ্ছেন তিনি।
কেশবপুর শ্রীগঞ্জ সাহাপাড়ার বাসিন্দা পাঁজিয়া ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক অনুকূল চন্দ্র মণ্ডল বলেন, পানির কষ্টের চেয়ে বড় কষ্ট আর কিছুতে নেই। পানি জোগাড় করাটা এখন ভীষণ কষ্টের হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আড়াই কিলোমিটার দূরের বায়সা গ্রাম থেকে আশুতোষের বাড়িতে পানি নিতে আসেন মাহবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘দিনেরাতে যখন আসি, বিদ্যুৎ থাকলেই দাদা পানি দেন। দুঃসময়ের এ উপকার ভোলার মতো নয়।’
নিজের ট্যাকের টাকায় পানি
আশুতোষ মজুমদার মণিরামপুর উপজেলার মর্শিমনগর স্কুল অ্যান্ড কলেজের আইসিটি বিষয়ের প্রভাষক। পাশাপাশি বাড়িতে একটি গরুর খামারের তদারকি করেন। খামারে ৯টি গরু আছে। এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এমনিতে তিনি সাদাসিধা প্রকৃতির মানুষ। সবাই তাঁকে ভালো বলেই জানেন। নিজের প্রচার-প্রচারণা চান না।
আগে আশুতোষ বিদ্যুৎ বিল দিতেন দুই হাজার টাকার মতো। এখন দুই মাস ধরে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা দিতে হচ্ছে। আগে বাড়ির ভেতরে তিনটি পানির কল (ট্যাপ) ছিল। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বাড়ির বাইরে আরও ১০টি কল বসিয়েছেন।
আশুতোষের স্ত্রী চমকলতা রায় মনে করেন তৃষ্ণার্ত মানুষকে পানি দেওয়া মহৎ কাজ। তাঁর স্বামী ভালো কাজই করছেন।
আগে দিনেরাতে যখন খুশি লোকে এসে পানি নিয়েছে, এমনকি মাঝরাতেও পানি দিয়েছেন আশুতোষ। এখন লোকজনকে পানি নেওয়ার একটা সময় বেঁধে দিয়েছেন। সকাল ৮টা থেকে বেলা ১১টা। এরপর বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত পানি নেওয়ার জন্য সবার জন্য দরজা খোলা।
আশুতোষের পানি দেওয়ার খবর শুনে অন্যদের মধ্যেও উৎসাহ তৈরি হয়েছে। মধ্যকূল মহিলা আলিম মাদ্রিসার সুপারিনটেনডেন্ট কফিল উদ্দীনও মানুষকে একই কায়দায় পানি দেওয়া শুরু করেছেন। তিনিও নিজের টাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে পানি সরবরাহ অব্যাহত রাখতে চান।