বাড়ছে লবণাক্ততা, বিশুদ্ধ পানির জন্য হাহাকার 

লবণাক্ততার প্রভাব পড়ছে এ অঞ্চলের জনস্বাস্থ্যে। বিশুদ্ধ পানির জন্য গ্রামের বাসিন্দাদের ছুটতে হচ্ছে দূরদূরান্তে। 

বাড়ির কাছে সুপেয় পানির উৎস না থাকায় দূরের গ্রাম থেকে নারীরা প্রতিদিন দল বেঁধে এভাবে কলসিতে পানি সংগ্রহ করেন। গত রোববার বিকেলে বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার পদ্মা গ্রামে
ছবি: মোহাম্মদ রফিক

বরিশালসহ দক্ষিণ উপকূলের মাটি ও পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় ক্রমে সংকুচিত হচ্ছে বিশুদ্ধ পানির উৎস। লবণাক্ততার এই আগ্রাসন শুধু ভূ–উপরিস্থ পানির আধার নয়, ভূগর্ভস্থ উৎসেও ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে নানা রোগ–ব্যাধি এ অঞ্চলের জনস্বাস্থ্যকে হুমকিতে ফেলছে। উপকূলে বিশুদ্ধ পানির কষ্ট প্রকট হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিশুদ্ধ পানির জন্য গ্রামের বাসিন্দাদের ছুটতে হচ্ছে দূরদূরান্তে।

এ পরিস্থিতির মধ্যেই সারা বিশ্বের মতো দেশেও আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব পানি দিবস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী প্রতিবছর ২২ মার্চ ‘বিশ্ব পানি দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে।

লবণাক্ততার প্রভাবে উচ্চ রক্তচাপ, প্রি-এক্লাম্পসিয়ার মতো আরও অনেক স্বাস্থ্যগত সমস্যা উপকূল এলাকায় প্রকট হচ্ছে। নারীদের এই সমস্যা বেশি ভোগাচ্ছে।
লিটন চন্দ্র সেন, সহযোগী অধ্যাপক, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) বরিশাল আঞ্চলিক কার্যালয়ের ২০০৯ সালের জরিপ অনুযায়ী, অতিমাত্রার লবণাক্ততার কারণে বরগুনা জেলায় ১৭ হাজার ৪৪০ হেক্টর, পটুয়াখালীতে ৩৬ হাজার ৩৯০ হেক্টর, ভোলায় ১২ হাজার ৭৭০ হেক্টর ও ঝালকাঠি জেলায় প্রায় ১ হাজার হেক্টর আবাদি জমি কমে গেছে। এতে দক্ষিণের শস্যভান্ডার খ্যাত এই চার জেলায় ফসল উৎপাদনের অনুপযোগী জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৭ হাজার ৬০০ হেক্টর।

মৃত্তিকা ও কৃষিবিশেষজ্ঞরা বলছেন, তড়িৎ পরিবাহিতা (ইসি) পানির লবণাক্ততা পরিমাপের একটা মাপকাঠি। পানিতে লবণাক্ততার সহনীয় মাত্রা হচ্ছে প্রতি সেন্টিমিটারে ৭৫০ মাইক্রোসিমেন্স। কিন্তু বরিশালের নদীগুলোর পানি সহনীয় মাত্রার অনেক বেশি পরিমাণে লবণাক্ত। বরগুনার বিষখালী নদীর পানির লবণাক্ততার পরিমাণ প্রতি সেন্টিমিটারে ২ হাজার ৮৪ মাইক্রোসিমেন্স, পটুয়াখালীর লোহালিয়া নদীতে প্রতি সেন্টিমিটারে ৩ হাজার ৭১ মাইক্রোসিমেন্স; পায়রা নদীর আমতলী অংশে লবণাক্ততা ১২ হাজার ৮০ মাইক্রোসিমেন্স, বলেশ্বর নদের পাথরঘাটার চরদুয়ানি অংশে ১৪ হাজার ৪০ মাইক্রেসিমেন্স পর্যন্ত লবণাক্ততা পাওয়া যায়।

সরেজমিন

বঙ্গোপসাগর তীরের বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার পদ্মা এলাকার গৃহবধূ জেসমিন আক্তারের পরিবারে সাতজন সদস্য। তাঁদের বাড়ির আশপাশে পুকুর আছে, কিন্তু পানি লবণাক্ত। গভীর নলকূপ বসানো হলেও সেগুলোতে কখনোই মিঠাপানি পাওয়া যায়নি। ফলে যুগ যুগ ধরে তাঁদের বিশুদ্ধ পানির জন্য ছুটতে হয় বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের খনন করা পুকুরে। পদ্মা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের ওই পুকুর পাড়ে ১০ হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতার একটি ‘পন্ড স্যান্ড ফিল্টার’ বসানো হয়েছে। এই ১০ হাজার লিটার পানির ওপর নির্ভরশীল পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের চারটি গ্রামের অন্তত ১২ হাজার মানুষ।

গৃহবধূ জেসমিন বেগম গত শনিবার বিকেলে সেখানে পানি নিতে এসে দুর্ভোগের বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, ‘এক ফোঁটা পানি জন্য মোগো যে সংগ্রাম করণ লাগে, হেইয়্যা কেউ বোঝবে না। এইহান দিয়া মোগো বাড়ি একি মাইল দূরে। ভরা কলস লইয়্যা এদ্দুর হাঁটন লাগে মোগো। বোঝেন এখন, কত্তো কষ্ট।’

পদ্মা স্লুইসগেট এলাকার বাসিন্দা গৃহবধূ আমেনা বেগম আক্ষেপ করে বলেন, ‘এক কলসি পানি লইয়্যা বাড়ি যাইতে পতে চাইর-পাঁচফির জিরান লাগে।’

হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিটি হেলথ অ্যান্ড হাইজিন বিভাগ ২০১৮ সালের জুনে এ নিয়ে একটি গবেষণা করে। গবেষণায় পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার টিয়াখালী ও বালিয়াতালী দুটি ইউনিয়ন থেকে মোট ১০০ নারীকে (যাঁদের পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুসন্তান রয়েছে) নিয়ে প্রথমে সমীক্ষা হয়। ওই এলাকার গভীর নলকূপ, পুকুর-খালের পানি এবং সমীক্ষায় অংশ নেওয়া নারীদের প্রস্রাবের নমুনা সংগ্রহ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়। নমুনা পরীক্ষায় দেখা যায়, ৫৮ ভাগ নারী প্রতিদিন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত মান থেকে ২ গ্রামের বেশি সোডিয়াম গ্রহণ করছেন। এটি নারীদের প্রস্রাব ও রক্তচাপে প্রভাব ফেলেছে।

গবেষণায় নেতৃত্ব দেন সহযোগী অধ্যাপক লিটন চন্দ্র সেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, লবণাক্ততার প্রভাবে উচ্চ রক্তচাপ, প্রি-এক্লাম্পসিয়ার (গর্ভকালীন খিঁচুনি) মতো আরও অনেক স্বাস্থ্যগত সমস্যা উপকূল এলাকায় প্রকট হচ্ছে—গবেষণায় এমন তথ্য পাওয়া গেছে। বিশেষ করে নারীদের এই সমস্যা বেশি ভোগাচ্ছে।

২০২১ সালে হঠাৎ করে এই অঞ্চলে ব্যাপক হারে ডায়রিয়া দেখা দেয়। ওই বছর ৭৬ হাজার ২৭৬ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। বেসরকারি বিভিন্ন সূত্রের হিসাবে ওই বছর বিভাগে ডায়রিয়ায় মারা যান ৩৬ জন। ২০১৩ সালে বিশ্ব ব্যাংক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, পানির বর্ধিত লবণাক্ততা ডায়রিয়ার ক্রমবর্ধমান হারের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছে। প্রতিবেদনে এ-ও বলা হয়, লবণাক্ত পানিতে কলেরার জীবাণু দীর্ঘকাল বেঁচে থাকে।