কটু কথা দমাতে পারেনি ৩ ফুট ২ ইঞ্চির জাহিদকে
শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী জাহিদ হাসান (২৩) ট্রেনে উঠলেই মানুষ দুই-চার টাকা ভিক্ষা দিতে চান। জবাবে তিনি বলে থাকেন, তিনি অতটা অসহায় নন। সর্বশেষ গত জুলাইয়ে একটি কাজে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। তখন ট্রেনে আসার সময় তাঁকে যাত্রীরা হাতে টাকা গুঁজে দিতে চেষ্টা করেছিলেন।
জাহিদের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর থানাধীন চৌডালা কলেজপাড়া গ্রামে। বাবা মো. জাক্কার আলী আর মা মোসা. রহিমা বেগম। দুই ভাই–বোনের মধ্যে জাহিদ বড়। জাহিদ এখন রহনপুর ইউসুফ আলী সরকারি কলেজে সমাজকর্ম বিভাগে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন। গত জুলাইয়ে তিনি একটি ল্যাপটপ সারাতে রাজশাহীতে এসেছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনি ঘুরে যান তাঁর সহপাঠীর কাছে। সেখানেই আলাপ হয় তাঁর সঙ্গে। সম্প্রতি মুঠোফোনে তাঁর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আর্থিক সংকটে পড়ে কিছুদিন হলো বাড়ির পাশে চায়ের দোকান দিয়েছেন। ভালোই চলছে। তবে ভবিষ্যতে কী হবে, জানেন না। পড়ালেখা চালিয়ে যাবেন। তবে তিনি কারও কাছে হাত পাততে চান না। শুধু যোগ্যতা অনুযায়ী রাষ্ট্রের কাছে একটি চাকরি চান।
জাহিদের উচ্চতা ৩ ফুট ২ ইঞ্চি। পা ও হাতের স্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়নি। এই শারীরিক গঠন নিয়েই তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন। হাতের অগ্রভাগে বেরিয়ে আসা আঙুল দিয়েই লিখে থাকেন বা অন্যান্য কাজ করেন।
জাহিদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জন্ম থেকেই জাহিদের শারীরিক গঠন যে স্বাভাবিক নয়, তা নজরে আসে বাড়ির সবার। আরেকটু বড় হলে বাড়ির পাশেই চৌডালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন মা–বাবা। মানুষজন অবজ্ঞা নিয়ে তাকাতেন তাঁর দিকে। অনেকেই তাঁর মা–বাবাকে পরামর্শ দিতেন, তাঁকে সার্কাস দলে পাঠিয়ে দিতে। মা–বাবা অন্যদের কথায় কান দেননি। বাবা–মায়ের উৎসাহেই জাহিদ পড়াশোনা করছেন।
প্রাথমিক পেরিয়ে জাহিদ ভর্তি হন একই গ্রামের চৌডালা দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে। বাবা সাইকেলে করে রোজ তাঁকে বিদ্যালয়ে নিয়ে যেতেন। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাসের কেউ বন্ধু হলো না। নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগ নিলেন। তখন বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে টিউশনি পড়তে হতো। সেখানে যাতায়াতে কষ্ট হতো। তখন কয়েকজন সহপাঠী তাঁকে সাইকেলে করে নিয়ে যেতেন। এভাবেই তাঁদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়।
জাহিদের ভাষ্য, নবম শ্রেণিতে উপবৃত্তির টাকা জমিয়ে স্মার্টফোন কেনেন জাহিদ। তখন থেকেই আউট সোর্সিংয়ের কাজ শেখেন। পরে কাজ পান। দৈনিক দুই শ টাকার মতো আয় হতো। এক বছর চলেছিল এটি। মুঠোফোনের টুকটাক সমস্যা সারতে পারেন, এ জন্য এলাকার মানুষ তাঁর কাছে আসেন। সেটা থেকে কিছু আয় হয়। কলেজে ওঠার পর উপবৃত্তি থেকে পাওয়া টাকা, নিজের টাকা ও পরিবার থেকে সহায়তা নিয়ে ল্যাপটপ কেনেন। প্রথম দিকে পারতেন না। পরে একজনের সহযোগিতায় শিখে নেন। ইউটিউব থেকেও শেখেন। আরেকজনের কাছ থেকে আউটসোর্সিংয়ের কাজ শিখে নেন। কাজ করে ডলার পেতেন। তবে ছয়-সাত মাস করার পর আর পেরে ওঠেননি।
জাহিদের পরিবারের লোকজন বলেন, জাহিদ ভালো নাচতে পারেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মানুষ তাঁকে ডেকে নেন। তাঁর নাচে মানুষ হাততালি দেয়, খুশি হয়। মানুষকে খুশি করতে পেরে তাঁর ভালো লাগে।
জাহিদ বলেন, এই জীবন নিয়ে কোনো আফসোস নেই। এই ছোট্ট জীবনে বহু মানুষের ভালো-মন্দ কথা শুনেছেন। সেগুলো এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। শুধু মাঝেমধ্যে খারাপ লাগে, মানুষ মানুষকে কেন অবহেলা করে, এই ভেবে। সবাই বাঁচতে চান সবাইকে নিয়ে, তিনিও এর বাইরের কেউ নন। তিনি কষ্ট করে পড়াশোনা করছেন। রাষ্ট্রের কাছে তিনি গুরুত্বহীন হতে চান না, রাষ্ট্র যেন তাঁর প্রতি সদয় হয়।
জাহিদের সঙ্গে ছোটবেলা থেকে পড়েছেন ইবতেসাম মাহফুজ। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ছেন। গত জুলাইয়ে তাঁর কাছেই কয়েক দিন ছিলেন জাহিদ। মাহফুজ বলেন, জাহিদের বাড়ির পাশেই তাঁর বাড়ি। জাহিদ খুব প্রত্যয়ী ছেলে। কিন্তু আর্থিক অনটনে পড়ে তাঁকে চায়ের দোকান দিতে হয়েছে।
জাহিদের মা রহিমা বেগম বলেন, ‘জাহিদ আমার একমাত্র ছেলে। জাহিদকে মানুষ করতে অনেক কটু কথা শুনতে হয়েছে। জাহিদকে পড়াশোনা করাচ্ছি, যাতে সে নিজে কিছু করতে পারে। পরিবার আর চলছে না। জাহিদের বাবা একটি রাইস মিলে কাজ করে। সেই আয়ে তো হয় না। ছেলেকে তাই চায়ের দোকানে বসাতে হয়েছে।’
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আবদুল মান্নান বলেন, তাঁর বাড়ি থেকে কিছু দূরেই জাহিদের বাড়ি। জাহিদ ছোটবেলা থেকে বহু কষ্টে বড় হচ্ছেন। জাহিদের চেষ্টা, মনোবল তাঁদের মুগ্ধ করে।