কক্সবাজারের সড়কে লবণপানি কেন এত বিপজ্জনক
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়ার বরইতলী ইউনিয়নের একতাবাজার। সেখান থেকে পশ্চিম-উত্তর-পশ্চিমে আঁকাবাঁকা পথে চলে গেছে ২৩ কিলোমিটার একতাবাজার-মগনামা সড়ক। এই সড়কের দুই পাশে কয়েক হাজার একর জমিতে করা হয়েছে লবণ চাষ। মাঠ থেকে তোলা লবণ যেমন সড়কের ওপর স্তূপ করা হচ্ছে, তেমনি রাত–দিন লবণবোঝাই ট্রাক চলাচল করছে সড়কটি দিয়ে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও যানবাহনের চালকেরা জানিয়েছেন, ভেজা লবণবোঝাই ট্রাক থেকে পড়া লবণপানিতে সড়কটি প্রায়ই পিচ্ছিল থাকে। এতে সড়কটিতে বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি। এ ছাড়া লবণপানিতে সড়কের বিভিন্ন অংশে কার্পেটিং উঠে গিয়ে ছোট-বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ প্রায় ৩৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে একতাবাজার-মগনামা সড়কটি নির্মাণ করে। গত বছরের জুন মাসে সড়কটি চালু করা হয়।
গত ১৩ ও ২৭ নভেম্বর দুই দফায় সড়কটি সরেজমিন পরিদর্শন করা হয়। এ সময় দেখা যায়, সড়কের বিভিন্ন অংশে মাঠে উৎপাদিত লবণ পাকা সড়কের ওপর স্তূপ করে রেখেছেন চাষিরা। ব্যবসায়ীরা সেই লবণ কিনে ট্রাকবোঝাই করে নিয়ে যাচ্ছেন চট্টগ্রামের পটিয়া, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, বাগেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়।
স্থানীয় ব্যবসায়ী আবদুল কাদের বলেন, সড়কটি নির্মিত হওয়ায় এলাকার দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া উপজেলার অন্তত ১০ লাখ মানুষের নিরাপদ যাতায়াতের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু লবণপানিতে দৃষ্টিনন্দন সড়কটি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দেখার কেউ নেই।
২৭ নভেম্বর সকালে সড়কে লবণ বোঝাই করতে দেখা যায় সাতটি ট্রাককে। জানতে চাইলে একটি ট্রাকের চালক সিরাজ উল্লাহ বলেন, সড়কের দুই পাশে লবণের মাঠ। সেখানে ট্রাক নামানোর রাস্তা নাই। তাই সড়কের ওপর ট্রাক রাখতে হয়েছে। আরেকটি ট্রাকের চালক আবুল কাশেম বলেন, গত ১০ নভেম্বর থেকে ট্রাকবোঝাই করে লবণ সরবরাহ শুরু হয়েছে। প্রতিদিন ৩০-৩৫ ট্রাকে লবণ সরবরাহ হচ্ছে।
মগনামা সড়কে লবণ কিনতে আসা চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটের ব্যবসায়ী নাছির উদ্দিন বলেন, সড়কপথ ছাড়া পেকুয়ায় উৎপাদিত লবণ চট্টগ্রাম ও ঢাকায় সরবরাহের বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই। তিনি পটিয়ার একটি লবণ কারখানায় সরবরাহের জন্য দুই ট্রাক লবণ কিনেছেন। ১০-১২ জন শ্রমিক সড়কের ওপর স্তূপ করে রাখা লবণ ট্রাকে তুলে দিয়েছেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, ট্রাকে করে লবণ বোঝাইয়ের সময় নিচে পলিথিন বিছানোর নির্দেশনা রয়েছে। তবে এই নির্দেশনা কেউ মানছেন না। জানতে চাইলে স্থানীয় লবণ ব্যবসায়ী রুহুল আমিন বলেন, ট্রাকে পলিথিন বিছানো হলে জমা হওয়া পানিতে অবশিষ্ট লবণও দ্রুত গলে যায়। তখন এক মণ লবণের মধ্যে অর্ধেকও টিকে থাকে না, ব্যবসায়ীদের লোকসান গুনতে হয়।
সওজ কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী রোকন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মগনামা-একতাবাজার সড়কের দুই পাশে কয়েক হাজার একরের লবণের মাঠ রয়েছে। উৎপাদিত লবণ সড়কের ওপর স্তূপ করে রাখা হয়। সড়কে লবণ স্তূপ এবং ট্রাকে বোঝাই করা বন্ধ করতে জেলা প্রশাসক ও পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।
কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়ার প্রধান সড়কে গাড়িতে বোঝাই হচ্ছে লবণ। তাতে লবণ পানি পড়ে সড়কের দুই পাশের অংশ ভেঙে যাচ্ছে। ২৭ নভেম্বর বিকালে, উত্তর ধুরুং এলাকায়। ছবি-প্রথম আলোজানতে চাইলে পেকুয়ার ইউএনও মোহাম্মদ মঈনুল হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মগনামা সড়কে ভ্রাম্যমাণ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। অভিযানে সড়কের ওপর লবণের স্তূপ করে রাখা এবং লবণ বোঝাই করার অভিযোগে তিনটি ট্রাকসহ ১০ জনকে আটক করা হয়। পরে ১০ জনকে ১ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। ট্রাকমালিকদের কাছ থেকেও মুচলেকা নেওয়া হয়েছে।
বিপজ্জনক ৩৫ সড়ক
সরেজমিন ঘুরে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একতাবাজার-মগনামা সড়কের মতো লবণপানিতে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে কক্সবাজারের পাঁচটি উপজেলার অন্তত ৩৫টি সড়ক। এসব সড়ক দিয়ে প্রতিদিন শতাধিক ট্রাক লবণ বহন করে।
বিসিকের তথ্য মতে, টেকনাফ, কক্সবাজার সদর, রামু, ঈদগাঁও, চকরিয়া, পেকুয়া, কুতুবদিয়া ও মহেশখালীর ২০ হাজার একরের বেশি জমিতে এখন লবণ উৎপাদন হচ্ছে। ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এর আগের ২৫ দিনে লবণ উৎপাদন হয়েছে ৪ হাজার ৭১৬ মেট্রিক টন। চলতি মৌসুমে (নভেম্বর থেকে এপ্রিল—পাঁচ মাস) জেলার ৬৬ হাজার একর জমিতে ২৬ লাখ ১০ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। গত বছর ওই পরিমাণ জমিতে লবণ উৎপাদন হয়েছিল ২৪ লাখ ৩৭ হাজার ৮৯০ মেট্রিক টন।
চাষিরা বলেন, লবণ উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সরবরাহও বাড়ছে। মহেশখালী, কুতুবদিয়ার অধিকাংশ লবণ কার্গো ট্রলারে ভরে সমুদ্রপথে সরবরাহ করা হয়। তবে টেকনাফ, কক্সবাজার, রামু, ঈদগাঁও, চকরিয়া, পেকুয়ার লবণ ট্রাক বোঝাই করে সরবরাহ করতে হচ্ছে।
সরেজমিন ঘুরে টেকনাফ-কক্সবাজার সড়কের হ্নীলা, জাদিমুরা, খারাংখালী, মিনাবাজার, হোয়াইক্যং এলাকায় সড়কের ওপর লবণের স্তূপ দেখা গেছে। সড়কের ওপর ট্রাক রেখে সেই লবণ বোঝাই করা হচ্ছে।
কক্সবাজার ট্রাকমালিক ঐক্য পরিষদের সভাপতি নঈমুল হক চৌধুরী বলেন, পলিথিন বিছিয়ে ট্রাকে লবণবোঝাইয়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে দীর্ঘসময় ধরে বলা হলেও কাজ হচ্ছে না। শীতের ঘন কুয়াশার মধ্যে লবণপানিতে পিচ্ছিল সড়কে যানবাহন চলাচল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এসব সড়ক অতিক্রম করার সময় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে।
লবণপানিতে সড়কের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে জানিয়ে নিরাপদ সড়ক চাই কক্সবাজার জেলার সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত চলতি বছরের ১১ মাসে জেলায় ১৮০টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ৩৬ জন, আহত হয়েছেন ৩৬০ জন।