মিরসরাইয়ে কালের সাক্ষী কাছারিঘর

বাঙালির শিক্ষা–সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে কাছারিঘরের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার নন্দনপুর গ্রামের ‘চৌধুরী বাড়ির’ শতবর্ষী কাছারিঘরছবি: প্রথম আলো

রংচটা চৌচালা টিনের ছাউনি। জায়গায় জায়গায় জং ধরেছে। মাটির তৈরি মোটা দেয়ালগুলোও জীর্ণ। কয়েক প্রজন্মের হাতে সংস্কারের পর কোনোমতে যেন টিকে আছে ঘরটি। ঘরের সামনে এখনো আড্ডা জমে। তবে আগের মতো জৌলুশ নেই। অথচ একসময় গ্রামীণ জনপদে কাছারিঘর নামে পরিচিত এ ধরনের ঘর ছিল শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সামাজিক আয়োজনের কেন্দ্র, এখন যা অনেকটাই স্মৃতি।

সম্প্রতি চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার নন্দনপুর গ্রামে ‘চৌধুরী বাড়ি’ গিয়ে দেখা মিলল এই কাছারিঘরের। ঘরের সামনে কথা হলো বাড়িটির প্রবীণ সদস্য আবু সুফিয়ান চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি জানান, এ কাছারিঘরটির বয়স ১০০ বছরের বেশি। তাঁদের পড়াশোনার হাতেখড়ি এই ঘরেই। বাড়ির গৃহশিক্ষকও থাকতেন এখানে। সকালবেলা মক্তব বসত। দিনের বেলায় হতো সালিশি বিচার।

আবু সুফিয়ান চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের বাড়ির কাছারিঘরটির গুরুত্ব বেশি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের জন্য। যুদ্ধের শুরুর দিকে এ কাছারিঘর ছিল বহু মানুষের আশ্রয়কেন্দ্র। তখন দিন–রাত রান্না হতো। দূরদূরান্ত থেকে এসে এখানে আশ্রয় নিত মানুষ। বিপদগ্রস্ত মানুষের থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থাও হতো এখানে। গত ১০০ বছরে কয়েক দফা সংস্কার করে এখনো কোনোমতে টিকিয়ে রাখা হয়েছে ঘরটিকে।’

বাংলাপিডিয়া থেকে জানা গেল, বাংলায় কাছারি শব্দটির প্রচলন সতেরো শতকে। সম্ভবত হিন্দি বা মারাঠি ভাষা থেকে উদ্ভূত হয়ে বাংলায় প্রচলিত হয় কাছারি শব্দটি।

তবে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে কাছারিঘর মিশে আছে ভিন্ন আবেদন নিয়ে। মুসাফিরখানা, মক্তব, গৃহশিক্ষকের থাকার ঘর, সালিশ-বৈঠক, পাঠাগার, নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডসহ বহুমুখী ব্যবহারে কাছারিঘর ছিল একসময় গ্রামাঞ্চলের অবস্থাসম্পন্ন বাঙালি বাড়ির আভিজাত্যের প্রতীক। তবে এখন কাছারিঘরের জৌলুশ নেই। সময়ের বিবর্তনে কাছারিঘরের অস্তিত্ব মুছে গেছে অনেক বাড়িতে।

কাছারিঘর তৈরি হতো বাড়ির সামনের অংশে অথবা উঠানের এক দিকে। ঘরগুলো তৈরি হতো নানাভাবে। কোনো কোনো কাছারিঘর হতো ইট–সুরকির ছোট দালানে। কোথাও খড় বা টিনের চালায় বাঁশের বেড়া বা মাটির দেয়ালে তৈরি। ঘরের ভেতরে পাতা থাকত পোক্ত গাছের চৌকি, চেয়ার–টেবিলসহ সাধ্যমতো আরও নানা ধরনের আসবাব। প্রশস্ত দরজা–জানালার এ ঘর প্রাণ জুড়াত সবার।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলার বার ভূঁইয়াদের একজন ঈশা খাঁর আমলে কর্মচারীরা বাড়ির দরজায় অবস্থিত কাছারিঘরে বসে খাজনা আদায় করতেন। ১৭৬৫ সাল থেকে জমিদারি দপ্তর ও সব রাজস্ব কার্যালয় কাছারি নামে পরিচিতি পেতে শুরু করে। তারও পরে ২০ শতকের শুরুর দিকের সাহিত্যে সরকারি, জেলা, জমিদারি, মহাজনি ও বানিয়া কাছারি প্রভৃতি নামের ব্যবহার লক্ষ করা যায়।

বাঙালির শিক্ষা–সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতেও কাছারিঘরের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। বাড়ির শিশুদের শিক্ষার হাতেখড়ির পাশাপাশি কাছারিঘরে বসত পুঁথিপাঠ, জারি–সারি গান ও খোশগল্পের মজলিশ।

মিরসরাইয়ে পাড়া আর গ্রামে কিছু বনেদি বাড়ির সামনে এখনো কাছারিঘর চোখে পড়ে। তবে বেশির ভাগ সংস্কারহীন, জীর্ণ, আধা ভাঙা। মিরসরাইয়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করেন জামশেদ আলম। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘একসময় আমাদের অঞ্চলে কাছারিঘর ছিল মর্যাদার প্রতীক। যে বাড়ির সামনে কাছারিঘর ছিল, সেই বাড়ির আলাদা মর্যাদা ছিল। তখন বাড়িতে বাড়িতে শিক্ষক রাখার চল ছিল। গৃহশিক্ষকেরা থাকতেন কাছারিঘরে। এ ছাড়া শিক্ষাকেন্দ্র, সমাজপতিদের বিচারিক কাজ, সামাজিক অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক আয়োজন ছাড়াও পাঠাগার হিসেবে ব্যবহার করা হতো কাছারিঘর।

মুক্তিযুদ্ধের সময় মিরসরাইয়ে বিভিন্ন বাড়িতে থাকা অনেক কাছারিঘর মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে বলে জানালেন জামশেদ আলম। তিনি বলেন, তখন এসব কাছারিঘরে আশ্রয় পেয়েছেন যুদ্ধে ঘরবাড়ি হারানো বহু মানুষ। এখন কাছারিঘরের সেই আবেদন নেই। অযত্ন আর অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে এ ঘরের সোনালি অতীত। যূথবদ্ধ সমাজের প্রতীক কাছারিঘর টিকিয়ে রাখা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।