শারীরিক প্রতিবন্ধী যমজ ছেলেকে নিয়ে মা-বাবার কঠিন সংগ্রাম
আদম আলী ও রেশেনা খাতুন দম্পতির ছয় সন্তানের পর জন্ম নেয় যমজ দুই ছেলে। একসঙ্গে হওয়ায় মা-বাবা আদর করে দুই ছেলের নাম রাখেন জামাল ও কামাল। জন্মের পাঁচ বছর পর্যন্ত সুস্থই ছিলেন তাঁরা। কিন্তু পাঁচ বছর পর থেকে অজানা এক রোগে দুই ভাইয়ের মাংসপেশি শুকিয়ে পা চিকন হয়ে যেতে থাকে। হারাতে থাকে স্বাভাবিক চলাফেরার শক্তিও। এভাবেই একসময় জামাল ও কামাল পুরোপুরি পঙ্গু হয়ে যান। শারীরিক প্রতিবন্ধী দুই ছেলেকে নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন মা–বাবা।
কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকা ইন্দা উত্তরহাটি এলাকায় আদম আলী ও রেশেনা খাতুন দম্পতির বাড়ি। ২০০৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন জামাল মিয়া (২০) ও কামাল মিয়া (২০)। হাওরের প্রত্যন্ত এলাকায় তাঁদের বসবাস।
এখান থেকেই প্রতি মাসে দুই থেকে তিনবার কিশোরগঞ্জ সদরের যশোদল এলাকায় শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য তাঁদের আসতে হয়। সেই সঙ্গে পড়াশোনার জন্য যেতে হয় মাদ্রাসায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়, জামাল ও কামাল ডুশেন মাসকুলার ডিসট্রফি (ডিএমডি) রোগে আক্রান্ত।
কিশোরগঞ্জের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আতাউর রহমান বলেন, ডিএমডি রোগ হলো একটি জন্মগত রোগ। জন্মের সময় বোঝা না গেলেও কিছুদিন পর থেকে মাংসপেশি শুকিয়ে যেতে থাকে। একসময় হাঁটাচলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এ রোগের নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নেই।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, ১৫ বছর ধরে দুই ছেলেকে নিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে আদম আলী ও রেশেনা খাতুন দম্পতিকে। রেশেনা খাতুনের অন্য ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করতে না পারলেও জামাল ও কামালকে উচ্চশিক্ষিত করাতে চান। আদম আলী দীর্ঘদিন ধরে কিডনি, হার্ট ও শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভুগছেন। তাঁদের বাকি ছয় সন্তান যাঁর যাঁর সংসার নিয়ে ব্যস্ত। জামাল ও কামালের সব দেখভাল রেশেনাকেই করতে হয়। কোলে করে দুই ছেলেকে শৌচাগারে নিয়ে যেতে হয় পঞ্চাশোর্ধ্ব তাঁকেই। দুই ছেলের শারীরিক পরিচর্যাও করতে হয় রেশেনাকেই।
সংসারের টানাপোড়েনে রেশেনার অন্য সন্তানেরা ছোটবেলা থেকেই অর্থ উপার্জনের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ফলে তাঁরা পড়ালেখা করতে পারেননি। তবে রেশেনার ইচ্ছা, তিনি যত দিন বেঁচে থাকবেন, তত দিন জামাল ও কামালকে পড়াবেন। প্রথমে দুই সন্তানকে মা কোলে করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়ে যেতেন। পরে বেয়ারিংয়ের গাড়ি বানিয়ে সেই গাড়িতে করে দুই ছেলে বিদ্যালয়ে নিয়ে যান। এখন হুইলচেয়ার ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা করে বাড়ি থেকে প্রায় পাঁচ থেকে সাত কিলোমিটার দূরে উরদিঘী দাখিল মাদ্রাসায় নিয়ে যান। সেখানে বর্তমানে দুই ভাই নবম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছেন।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি করিমগঞ্জের ইন্দা উত্তরহাটি এলাকায় জামাল-কামালদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, এক ছেলেকে কোলে করে মা; আরেক ছেলেকে প্রতিবেশী এক যুবক কোলে করে বাইরে বের করছেন। জামালকে হুইলচেয়ারে আর কামালকে প্লাস্টিকের চেয়ারে শরীরে রোদ লাগানোর জন্য বসিয়ে রেখেছেন। এভাবেই দীর্ঘ দেড় দশক ধরে অন্যের ওপর ভর করে তাঁদের চলাচল করতে হচ্ছে।
সেখানে আলাপকালে রেশেনা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় চার বছর ধরে তাঁর দুই সন্তান বমির সমস্যায় ভুগছেন। খাওয়ার পর কোনো কিছু তাঁদের হজম হচ্ছে না। এক ছেলের কোনো সমস্যা হলে অন্য ছেলেও একই সমস্যায় ভোগেন।
রেশেনা আরও বলেন, তাঁর পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে। এর মধ্যে সবার ছোট যমজ জামাল ও কামাল। তাঁদের জন্য প্রতি মাসে ওষুধ খরচ বাবদ চার হাজার টাকা লাগে। মাদ্রাসায় যাতায়াত ও মাসে অন্তত দুবার হাসপাতালে যাওয়া-আসা করতে অনেক খরচ। সংসারই চলে না, এত খরচ কীভাবে চলাবেন—ভেবে কোনো কূলকিনারা করতে পারচ্ছেন না তিনি।