মাইকিং করে লোক জড়ো, রাস্তা নিয়ে দুই গ্রামের লোকজনের সংঘর্ষ
কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলায় চলাচলের রাস্তা নিয়ে দুই গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এ ঘটনায় অর্ধশতাধিক লোক আহত হয়েছেন। সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে উপজেলার গুণধর ইউনিয়নের ইন্দা ও চুল্লী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়। এর আগে চুল্লী গ্রামের দোকানপাট ও বাড়িঘরে লুটপাট চালানো হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
আহত ব্যক্তিদের মধ্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন পাঁচজন। তাঁদের ঢাকা ও ময়মনসিংহে পাঠানো হয়েছে। বাকিদের মধ্যে আরও অন্তত ১০ জনকে কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। চুল্লী গ্রামের বাসিন্দাদের অভিযোগ, সংঘর্ষের আগের রাতে ইন্দা গ্রামে মাইকিং করে সংঘর্ষে অংশ নেওয়ার জন্য লোকজনকে ডাকা হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গুণধর ইউনিয়নের ইন্দা, চুল্লী ও কন্ডবখালী—এই তিন গ্রামের একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এর পাশে চুল্লী গ্রামের চলাচলের রাস্তা। সম্প্রতি ওই রাস্তার ওপর দিয়ে বিদ্যালয়ের সীমানাদেয়াল তোলার সিদ্ধান্ত হয়। এর পর থেকে ইন্দা ও চুল্লী গ্রামের বিবাদ শুরু হয়। যাতায়াতের পথ রেখে দেয়াল তোলার দাবি জানান চুল্লী গ্রামের লোকেরা। কিন্তু রাস্তা না রেখে স্কুলের দেয়াল তোলার জন্য কয়েক দফা চেষ্টা চালান ইন্দা গ্রামের কয়েকজন। বিষয়টি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান পর্যন্ত গড়ানোর পর সিদ্ধান্ত হয়, রাস্তা রেখেই বিদ্যালয়ের দেয়াল নির্মাণ করা হবে।
এর মধ্যে রোববার রাতে ইন্দা গ্রাম থেকে লোক জড়ো করার জন্য মাইকিং করা হলে চুল্লী গ্রামে উত্তেজনা দেখা দেয়। সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে স্কুলের সামনে ইন্দা গ্রামের কয়েক শ লোক জড়ো হন। দেয়াল নির্মাণে বাধা দিলে ইন্দা গ্রামের কিছু লোক চুল্লী গ্রামবাসীর ওপর আক্রমণ করেন।
চুল্লী গ্রামের বাসিন্দা দুলাল হোসাইন বলেন, ‘ইন্দা গ্রামের লোকেরা সকালে এসে আমাদের চলাচলের রাস্তা না রেখে পাশের ঈদগাহের দেয়াল ঘেঁষে দেয়াল নির্মাণের জন্য মাটি খোঁড়া শুরু করে। আমরা প্রতিবাদ জানালে তারা দা-বল্লম, লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালায়। বাড়িঘর ভাঙচুর করে।’
চুল্লীর বাসিন্দা সাহেদ আলী (৭৮) বলেন, ইউপি চেয়ারম্যান সালিসে স্কুলের জায়গা থেকে সাড়ে চার ফুট রাস্তা রেখে দেয়াল নির্মাণ করার কথা বলেন। এরপরও ইন্দা গ্রামের কয়েকজন চলাচলের রাস্তা না রেখেই দেয়াল নির্মাণ শুরু করেন। তাঁরা এতে আপত্তি জানালে হামলা চালানো হয়। কন্ডবখালী গ্রাম ও পাশের নিকলী উপজেলা থেকে ভাড়াটে সন্ত্রাসীও নিয়ে আসেন তাঁরা।
স্থানীয় বাসিন্দা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মজিদ জানান, তাঁরা শত বছর ধরে এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করছেন। স্কুল তো হয়েছে অনেক পরে। এই গ্রাম থেকে বাইরে বের হওয়ার একমাত্র রাস্তা এটিই। গ্রামের ফসলাদি এ রাস্তা দিয়ে বাড়িতে আনা হয়। এ রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে ইন্দা গ্রামের মানুষের কী লাভ?
সংঘর্ষে ইটের আঘাতে আহত চুল্লী গ্রামের গুলনাহার বলেন, ‘গ্রামের ঘরবাড়িতে এসেও হামলা চালিয়েছে ইন্দা গ্রামের লোকেরা। আর এ হামলায় সরাসরি মদদ দিয়েছে ইন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুর রশিদ। তিনি ও তার ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা আমাদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়েছে।’
অভিযোগ অস্বীকার করে প্রধান শিক্ষক আবদুর রশিদ বলেন, ‘স্কুল মাঠের রাস্তা নিয়ে সংঘর্ষ হয়েছে। আমি যেহেতু এই স্কুলে চাকরি করি, তাই ঘটনা শুনে আমার আত্মীয়স্বজন এসেছে। নিকলী উপজেলার নানশ্রী আমার পাশের গ্রাম। ওখানেও আমার আত্মীয় রয়েছে। আমার ওপর আক্রমণ হয়েছে শুনে ওরাও এসেছিল।’
সংঘর্ষের বিষয়ে ইন্দা গ্রামের পল্লিচিকিৎসক মুজিবুর রহমান বলেন, ‘চুল্লী গ্রামের লোকেরা স্কুলের মাঠ দখল করে মাঠের ওপর দিয়ে রাস্তা নিতে চায়। সাড়ে চার ফুট রাস্তা রেখে দেয়াল নির্মাণের ব্যাপারে চেয়ারম্যান চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার পরও চুল্লীর লোকেরা সেটা মানতে চায়নি। আমরা মীমাংসা করতে গেছি। বরং ওরাই আক্রমণ করে আমাদের গ্রামের লোকজনকে জখম করেছে।’
চুল্লী গ্রামের বাসিন্দাদের দাবি, এ ঘটনায় তাঁদের পক্ষ থেকে ৩০–৪০ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে খুরশিদ উদ্দিনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাঁকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ছাড়া ইকরাম উদ্দিন, খুরশিদুর রহমান, মেরাজ মিয়া, রাজন মিয়া ও দ্বীন ইসলামকে কিশোরগঞ্জের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অপর দিকে ইন্দা গ্রামের আবদুল হাই ও বিল্লাল হোসেন আহত হয়ে ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বলে জানা গেছে। সংঘর্ষে ইন্দা গ্রামের আরও ১৫ জন আহত হয়েছেন।
গুণধর ইউপির চেয়ারম্যান আবু সায়েম ভূঞা বলেন, যে রাস্তা নিয়ে সংঘর্ষ হয়েছে, এটি গ্রামের চলাচলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে চুল্লী গ্রামবাসীর জন্য রাস্তা রেখেই মীমাংসা করে দিয়েছিলেন তিনি। এরপরও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, এটি দুঃখজনক।
সন্ধ্যা পর্যন্ত এ ঘটনায় থানায় কোনো মামলা হয়নি। করিমগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান বলেন, সংঘর্ষের খবর শুনেই পুলিশ নিয়ে তিনি ঘটনাস্থলে যান। দুই পক্ষেরই কিছু লোক আহত হয়েছেন। তাঁরা যাওয়ার পর পরিস্থিতি শান্ত হয়। ঘটনাস্থলে এখনো পুলিশ রয়েছে। তবে এ ব্যাপারে কাউকে আটক করা হয়নি। এখনো কোনো পক্ষ অভিযোগও করেনি। অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।