হিজলী: স্মার্ট এক গ্রামের গল্প
পিছিয়ে পড়া একটি গ্রাম। মানুষজন ছিল দরিদ্র। ২৪টি এনজিও ঋণ কার্যক্রম চালাত। সাপে কাটা রোগীকে নেওয়া হতো ওঝার কাছে। প্রায়ই ঘটত আত্মহত্যার মতো ঘটনা। বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েদের বসতে হতো বিয়ের পিঁড়িতে।
এখন দিন পাল্টেছে। গ্রামের নারীরা আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছেন। বন্ধ হয়েছে বাল্যবিবাহ। আত্মহত্যা হয় না গ্রামটিতে। পরিত্যক্ত খেলার মাঠ সংস্কার করে নিয়মিত খেলাধুলা হচ্ছে। বেকার তরুণেরা প্রশিক্ষণ নিয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি হচ্ছেন। বাড়ির আঙিনায় চাষ হচ্ছে বিষমুক্ত শাকসবজি। কেউ আর বাইরে গৃহস্থালির বর্জ্য ফেলেন না। রাস্তার মোড়ে মোড়ে আছে ডাস্টবিন। নানা সেবা পেতে গ্রামের বাসিন্দাদের জন্য আছে স্মার্টকার্ডের ব্যবস্থা।
আগাগোড়া বদলে যাওয়া গ্রামটি ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলায়, নাম হিজলী। শুরুটা করেছিলেন দুই সরকারি কর্মকর্তা আর এক জনপ্রতিনিধি মিলে। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন গোটা গ্রামের মানুষ আর উপজেলা প্রশাসনের নানা দপ্তর। শুরুতে গ্রামের বাসিন্দাদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেন তাঁরা। পরে একে একে সেসব সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেন। মাত্র এক বছরের মাথায় পাওয়া যায় সাফল্য। অনেকেই এখন গ্রামটিকে ‘স্মার্ট ভিলেজ’ বলছেন।
তিনজনের উদ্যোগ, সুফল সবার
কাপাশহাটিয়া ইউনিয়নের হিজলী গ্রামটিতে ৩৩৪টি পরিবারে প্রায় দেড় হাজার মানুষের বাস। তাঁদের মধ্যে ৪৬ চাকরিজীবী। বাকিরা কৃষিকাজ ও ব্যবসা করেন। হিজলীর তিন পাশে গ্রাম আর উত্তর পাশজুড়ে কাপাশহাটিয়া বাঁওড়। বাঁওড়ের পাড় দিয়ে বয়ে গেছে ঝিনাইদহ-হরিণাকুণ্ডু সড়ক। এই সড়কে চলাচলকারীরা বাঁওড়টির পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হন। অনেকে নেমে কিছুটা সময় বিশ্রাম নিয়ে যান। বাঁওড়টি ঘিরে একটি দর্শনীয় স্থান গড়ে তোলার ভাবনা গ্রামের অনেকের মনেই ছিল।
স্থানীয় অনেকের মতো স্বপ্নটি দেখেছিলেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হাফিজ হাসান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুস্মিতা সাহা। বাঁওড়পাড়ের সৌন্দর্য বাড়াতে দুজনে মিলে পরামর্শ করলেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন স্থানীয় কাপাশহাটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য আবদুল হাকিম। তাঁরা ঠিক করলেন, কাজটি করতে হবে স্থানীয় মানুষ আর সরকারি দপ্তরগুলোর সমন্বয়ে। যেখানে সরকারি কোনো বরাদ্দের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। সরকারি দপ্তরগুলো দৈনন্দিন কাজের সঙ্গে হিজলী গ্রামকে যুক্ত করে কাজ করে যাবে।
একে অনুসরণীয় উদ্যোগ উল্লেখ করে হরিণাকুণ্ডুর ইউএনও সুস্মিতা সাহা বলেন, একটি গ্রামকে স্বনির্ভর করা, গ্রামকে সবুজয়ান করা, সন্ত্রাসমুক্ত, বেকারমুক্ত করার কাজ চলছে। গ্রামে কোথায় কোথায় সমস্যা, তা চিহ্নিত করা হয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হচ্ছে, চলছে নানামুখী প্রশিক্ষণ। এটি গোটা দেশের জন্য মডেল হতে পারে।
জরিপ করে সমস্যা চিহ্নিত
স্মার্ট গ্রাম প্রতিষ্ঠার শুরুতেই জরিপ কাজে হাত দিলেন তাঁরা, জানালেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হাফিজ হাসান। সে ২০২০ সালের কথা। প্রতিটি পরিবারের তথ্য সংগ্রহ করা হলো। জরিপে বেরিয়ে এল গ্রামের দুর্বল দিকগুলো। জানা গেল, হিজলী গ্রামে শিক্ষার হার ৫০ শতাংশ। ২০টি মেয়ে রয়েছে বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে। পাঁচজন প্রতিবন্ধী আছে। রয়েছে বাড়ির পাশে অনাবাদি জমি। নারীদের অনেকে কাজ জেনেও সুযোগের অভাবে ঘরে বসে সময় কাটান। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম। বাচ্চারা পড়ালেখার পাশাপাশি বিনোদন পায় না। গ্রামের মানুষের সেবা পেতে ছুটতে হয় দালালের কাছে। খেলার মাঠটি জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে আছে। নেই নিয়মিত খেলাধুলা।
বলে চললেন হাফিজ হাসান। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার পরপরই ২০২২ সালের মে থেকে তাঁরা কাজে নেমে পড়লেন। শুরুতেই কাজ ভাগাভাগি করে নিলেন। সরকারি দপ্তর, গ্রামের সাধারণ মানুষ, এনজিও প্রতিনিধি, স্কুলশিক্ষক, জনপ্রতিনিধি সবার সঙ্গে পৃথক বৈঠক করলেন। জরিপ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাঁরা ৫০ ধরনের কাজ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলেন। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে মাঠপর্যায়ে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করলেন।
গ্রামজুড়ে যত কর্মযজ্ঞ
উপজেলা কৃষি বিভাগ ওই গ্রামের কৃষকদের নিয়ে কাজ শুরু করল। তারা গ্রামে ৫০টি বাড়ির পাশে বিষমুক্ত সবজির চাষ করল। ওই সব পরিবার এখন আর সবজির জন্য বাজারে ছোটে না। তিনটি বাড়িতে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন করা হলো। ২০টি বাড়ির রান্নাঘরের আবর্জনা থেকে জৈব সার তৈরি হচ্ছে।
স্বাস্থ্য বিভাগ গ্রামে একটি ফার্মেসি প্রতিষ্ঠা করে দিল। সেখানে সপ্তাহে এক দিন একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রোগী দেখা শুরু করলেন। জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর গ্রামের ২১০টি নলকূপের পানি পরীক্ষার ব্যবস্থা নিল। দরিদ্র কৃষকদের কৃষিঋণের ব্যবস্থা করতে ব্যাংকগুলো কাজ করছে। তারা নিয়মিত কৃষিঋণ দিচ্ছে।
গ্রামের নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য কাজ করছে উপজেলা মহিলা অধিদপ্তর। তারা নারীদের নানাভাবে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। ইতিমধ্যে সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে ৫০ জন নারীর কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া হয়েছে। গ্রামের রাস্তাগুলো ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে সেখানে আলোর ব্যবস্থা করা হলো। পোস্টবক্সের আদলে গ্রামে বেশ কিছু বাক্স স্থাপন করা হলো। সেখানে চিরকুট ফেলে সেবাগ্রহীতারা দ্রুত সেবা নিতে পারেন।
জনা চল্লিশেক নারীকে নিয়ে সুঁই–সুতায় অপূর্ব নকশার সব কাজ করেন হিজলী গ্রামের রুবিনা খাতুন। তিনি বললেন, সংসারের কাজের পাশাপাশি তাঁরা এ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। যা আয় হচ্ছে, তা সংসারের কাজে লাগছে। তাঁদের তৈরি পণ্য ঢাকার একটি বিখ্যাত হস্তশিল্পজাত পণ্য বিপণন প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা হয়।
আছে স্মার্টকার্ড, আউটসোর্সিং
সরকারি নানা সুযোগ–সুবিধা, ভাতা সমানভাবে পেতে জাতীয় পরিচয়পত্রের বাইরে গ্রামের বাসিন্দাদের জন্য স্মার্টকার্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইতিমধ্যে শতাধিক ব্যক্তি ‘হিজলী স্মার্ট ভিলেজ কার্ড’ নামে বিশেষ সেই কার্ড পেয়েছেন। প্রথমে বয়স্কদের দেওয়া হচ্ছে, পর্যায়ক্রমে সবাইকে দেওয়া হবে। উপজেলা আইসিটি বিভাগের উদ্যোগে তৈরি সেই কার্ডে কিউআর কোড আছে। কোডটি স্ক্যান করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাম, পরিচয়, কার্ড নম্বরসহ তিনি কী কী ভাতা ও সুযোগ–সুবিধা পান, সে তথ্য পাওয়া যায়।
এই কার্ড থাকার বড় সুবিধা হচ্ছে, কার কী প্রয়োজন, সে অনুযায়ী সরকারি সুবিধা ভাগ করা, সরকারি উপকারভোগী কারা হবেন তার তালিকা সহজে নির্ধারণ করা যায় বলে উল্লেখ করলেন ইউপি সদস্য আবদুল হাকিম।
গ্রামের বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য কাজ করছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর। তারা যুবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। ইতিমধ্যে গ্রাফিক ডিজাইনের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন কয়েকজন যুবক। আউটসোর্সিংয়ের কাজও শুরু করেছেন কেউ কেউ। পাশাপাশি যুবকদের নিয়ে ক্লাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ৪০ সদস্যের এই ক্লাবের সদস্যরা নিয়মিত খেলাধুলার আয়োজন করছেন। তাঁরা গ্রামে বৃক্ষরোপণ, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোসহ নানা কাজে সম্পৃক্ত।
গ্রামের যুব স্পোর্টিং ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আল-আমিন বললেন, তাঁদের গ্রামে দীর্ঘদিনেও একটি ক্লাব হয়নি, এখন হয়েছে। সেখানে নিয়মিত বসছেন, খেলাধুলা করছেন। অল্প দিনে গ্রামের এমন উন্নয়ন নিজেও বিশ্বাস করতে পারছেন না যেন। তাঁদের গ্রাম একদিন ‘স্মার্ট ভিলেজের’ মর্যাদা পাবে, এমন স্বপ্ন দেখেন আল–আমিন।