খেলনার মায়ায় জীবন বাঁধা
আফজাল হোসেন ফকির মাত্র ১৮ বছর বয়সে বিয়ে করে বসলেন। সেটা ১৯৬০-এর দশক। তাঁর তখন কোনো চালচুলো নেই। বগুড়ার দুপচাঁচিয়ায় খোলাশ গ্রামে কোনো কাজ নেই। বাবারও অভাবের সংসার। আফজাল নিজে কী খাবেন, নতুন বউকেই-বা খাওয়াবেন কী! দিশাহারা আফজাল শেষমেশ বাবার কাজেই ভিড়ে গেলেন।
বাবা সুলতান ফকির বানাতেন খেলনা। টমটম, টরটরি, বেহালা—হরেক পদের খেলনা। বাবার কাছে হলো তাঁর খেলনা গড়ার হাতেখড়ি। খেলনা বানিয়ে সেসব নিয়ে বাবার সঙ্গেই ছুটে যেতেন দেশের নানা প্রান্তে বড় বড় মেলায়। সেই থেকে শুরু। এরপর আফজাল ফকির নিজেই খেলনার কারিগর হিসেবে বিরাট নাম করে ফেললেন। সারা দেশ থেকে পাইকারেরা খেলনা কিনতে ভিড় করতে লাগলেন তাঁর বাড়িতে।
আফজাল ফকিরের বয়স এখন ৮০ বছর। এই বয়সেও খেলনা তৈরিতে তাঁর বিন্দুমাত্র ক্লান্তি নেই। পোড়ামাটি আর বাঁশের কাঠি দিয়ে তৈরি সেসব খেলনা নিয়ে নিজেই দেশের এ কোণ থেকে সে কোণ বড় বড় মেলায় ছুটে বেড়ান। মেলায় পসরা সাজিয়ে বসেন।
চৈত্রসংক্রান্তি আর পয়লা বৈশাখের মেলার কারণে আফজাল ফকিরের তাই দম ফেলার সময় নেই।
বুধবার আফজাল ফকিরের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, উঠানে বসে তিনি খেলনা তৈরিতে মগ্ন। কথায় কথায় স্মৃতিচারণা করে বললেন, খোলাশ গ্রামে দারিদ্র্যের কোনো সীমা ছিল না। মোটেই কোনো উপার্জন ছিল না কারও। কারও যদিও-বা মাটির ঘর ছিল, খড়ের ছাউনি লাগানোর সামর্থ্য ছিল না। তাঁর বাবা সুলতান ফকির নীলফামারীর সৈয়দপুরে বিহারিপল্লিতে খেলনার কারখানায় কাজ নিয়েছিলেন। পরে বাড়িতে ফিরে খেলনা তৈরি শুরু করেন। বাবার হাত ধরে এসেছেন এই পেশায়। বছরজুড়েই তাঁর ব্যস্ততা। তবে চৈত্রসংক্রান্তি আর পয়লা বৈশাখ ঘনিয়ে এলে ব্যস্ততার কোনো সীমা-পরিসীমা থাকে না।
আফজাল ফকির বললেন, আষাঢ়, শ্রাবণ আর ভাদ্র—এই তিন মাস ছাড়া বছরের বাকি ৯ মাসই তাঁর কর্মযজ্ঞ চলতে থাকে। খুলি-কাঠ, বাঁশ আর রংবেরঙের কাগজে ভরে থাকে তাঁর বাড়ির উঠান আর আঙিনা। বাড়ির মেয়েরা করেন খেলনায় রং লাগানো আর কাগজে আলপনা আঁকার কাজ।
চৈত্র, বৈশাখ আর জ্যৈষ্ঠ মাস খেলনা বিক্রির ভরা মৌসুম। কারণ, এই তিন মাসে সারা দেশে বসে শত শত মেলা আর উৎসব। ঢাকায় রমনার বৈশাখী মেলা, আজিমপুরের মেলা, দোহারের নুরুল্যাপুর মেলা; চট্টগ্রামের লালদীঘির জব্বারের বলীর মেলা আর সানাল ফকিরের মেলা; কুষ্টিয়ার লালন মেলা; যশোরের মধু মেলা; ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়া মেলা; দিনাজপুরের চরকাই মেলা, আমবাড়ি মেলা, গোপালপুর চৌধুরী মেলা; জয়পুরহাটের গোপীনাথপুর মেলা; ফরিদপুরের পল্লীকবি জসিমউদ্দীন মেলা; নড়াইলে সুলতান মেলা; রাজশাহীর বাঘা ঈদ মেলা; গাইবান্ধার রাজাবিরাট মেলা; বগুড়ার পোড়াদহ, বগুড়ার কেল্লাপশী ও গাংনগর মেলা, রাজশাহীর বাঘা মেলা—এ রকম কত মেলা!
বয়সী এই কারুশিল্পী জানালেন, তাঁর তৈরি খেলনা সারা দেশের পাইকারেরা এসে যেমন কিনে নিয়ে যান, তেমনি তিনি নিজেও মেলায় মেলায় গিয়ে বিক্রি করেন। তিনি বললেন, টমটমের জন্য মাটির খুঁড়ি আর চাকা সংগ্রহ করা হয় পালপাড়া থেকে। প্রতিটি মাটির খুঁড়ি ও চাকার দাম পড়ে দুই টাকা। মাটির খুঁড়ি দিয়ে তৈরি টমটম, টরটরি আর প্লাস্টিকের পাখি-ফুল সব খেলনাতেই লাগে কাঠের হাতল। করাতকল থেকে হাতল সংগ্রহ করে তাতে রং লাগান। ষাটের দশকে প্রতিটি খেলনা বিক্রি হতো এক পয়সায়। এখন বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকায়।
আফজাল ফকির বললেন, তাঁর বাবা সুলতান ফকিরসহ তিনজন মানুষের হাত ধরে এ গ্রামে খেলনা তৈরি শুরু হয়েছিল। এখন এতে জড়িয়ে আছেন শতাধিক পরিবারের হাজারো কারিগর। খোলাশ গ্রামে এখন বছরে প্রায় অর্ধকোটি টাকার খেলনার বাজার। দিনরাত ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে খেলনা। তৈরি হচ্ছে হাতে হাতে। বিদ্যুচ্চালিত কারখানায় তৈরি হচ্ছে প্লাস্টিকের খেলনা। খেলনা করে দিয়েছে হাজারো মানুষের রুটিরুজির ব্যবস্থা।
আফজাল ফকির বললেন, ‘একেকটি খেলনা আমার কাছে সন্তানের মতো। খেলনা বানাতে হয় দিলের দরদ ঢেলে দিয়ে।’ দুঃখ করে বললেন, প্লাস্টিকের তৈরি আর চীন থেকে আসা ইলেকট্রিক খেলনার ভিড়ে, মুঠোফোনের গেমের তোড়ে শিশুদের কাছে মাটির খেলনার কদর কমে গেছে। এই প্রতিযোগিতায় টেকা দায়। তবু ৬২ বছরের এ পেশার মায়ায় বাঁধন কেটে তিনি বের হবেন কী করে! এই খেলনা তৈরির নেশার মধ্যেই তিনি জীবনটা পার করে দিতে চান।