কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত ভ্রমণে ভোগান্তি, তথ্যকেন্দ্রে মিলছে সুরাহা
২৮ ডিসেম্বর সকাল আটটা। কক্সবাজারের কলাতলী সৈকতে নামেন মৌলভীবাজার থেকে আসা রাসেল মিয়া। তখন ভ্রাম্যমাণ এক আলোকচিত্রী রাসেলকে ছবি তুলে দেওয়ার আবদার করেন। রাসেলও রাজি হন। চুক্তি হয় ক্যামেরায় তোলা ছবি থেকে ৪ টাকা দরে ১০০ ছবি নেবেন রাসেল।
কিন্তু আলোকচিত্রী কয়েক শ ছবি তুলে রাসেলের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন ২ হাজার ৭০০ টাকা। টাকা খুইয়ে জেলা প্রশাসনের তথ্য ও অভিযোগকেন্দ্রে নালিশ করে রাসেল ফিরে পান দেড় হাজার টাকা।
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারে ২৪ ডিসেম্বর থেকে লাখো পর্যটকের সমাগম ঘটেছে। গতকাল বুধবার রাত পর্যন্ত অন্তত ছয় লাখ পর্যটক কক্সবাজার ভ্রমণে আসেন। কিন্তু নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন পর্যটকেরা। হোটেল-রিসোর্ট-কটেজে অতিরিক্ত ভাড়া, লাইসেন্সবিহীন রেস্তোরাঁয় ভেজাল ও নিম্নমানের খাবার, দর্শনীয় স্থানে যেতে ছোট-বড় যানে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়সহ নানা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। এ জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তথ্য ও অভিযোগকেন্দ্র খোলা হয়েছে। রাসেলের মতো অনেক পর্যটক সেখানে অভিযোগ করে সুরাহা পাচ্ছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থেকে সমুদ্র দেখতে এসেছেন ঠিকাদার আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, গতকাল সকাল সাতটায় কলাতলী মোড়ে বাস থেকে নামতেই কয়েকজন দালাল তাঁকে ঘিরে ধরে টানাটানি শুরু করেন। এক ইজিবাইকচালক তাঁকে আধা কিলোমিটার দূরের একটি হোটেলে তুলে দিয়ে আড়াই শ টাকা ভাড়া দাবি করেন; যদিও এটুকু রাস্তার ভাড়া মাত্র ৫০ টাকা।
পর্যটক ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রাতের বাসে আসা পর্যটকেরা সকালে শহরের কলাতলীর হাঙর ভাস্কর্য মোড়ে নামেন। এ সময় হোটেল-রিসোর্টে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে পর্যটকদের টানাটানি শুরু করেন কতিপয় দালাল। কিছু ইজিবাইকচালক কম টাকায় কক্ষ ভাড়া নিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে পর্যটকদের চিহ্নিত কিছু হোটেলে নিয়ে যান। পরে পর্যটকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়।
কক্সবাজার হোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সেলিম নেওয়াজ বলেন, কলাতলীর মোড়ে কতিপয় দালাল পর্যটক ধরতে ওত পেতে থাকেন। ইজিবাইকে দর্শনীয় স্থান ঘোরানোর কথা বলে নির্জন স্থানে নিয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনাও আছে। তবে এখন প্রশাসন তৎপর হওয়ায় এগুলো কমেছে। পর্যটকেরা এখন অভিযোগ করার সুযোগ পাচ্ছেন। বর্তমান জেলা প্রশাসক যোগদানের পর পর্যটকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় তথ্য ও অভিযোগকেন্দ্র চালুর পাশাপাশি একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে নামিয়েছেন।
তথ্যকেন্দ্রে অভিযোগ কম, সহায়তা বেশি
পর্যটকদের অভিযোগ শুনতে কলাতলীর হাঙর ভাস্কর্য মোড়ে ২৪ ডিসেম্বর তথ্য ও অভিযোগকেন্দ্র স্থাপন করে জেলা প্রশাসন। গতকাল পর্যন্ত চার দিনে অভিযোগ করেছেন ২০ পর্যটক। নানা বিষয়ে তথ্য ও সহায়তা চেয়েছেন ১৭০ জন। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ছিল ভ্রাম্যমাণ আলোকচিত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহার ও অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নেওয়া। এ ছাড়া দালালের খপ্পরে পড়ে টাকা হারানো, সৈকতে ময়লা-আবর্জনাসহ নানা ভোগান্তির কথা তুলে ধরেছেন অনেকে।
৮ ডিসেম্বর কক্সবাজারে যোগদান করেন জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান। তাঁর নির্দেশে পর্যটক হয়রানি রোধে তথ্য ও অভিযোগকেন্দ্রটি স্থাপন করা হয়। হোটেল-রেস্তোরাঁ, গেস্টহাউস, পরিবহনসহ যেকোনো সমস্যা অভিযোগকেন্দ্রে লিখিতভাবে জানালে পর্যটকেরা তাৎক্ষণিকভাবে সেবা পাচ্ছেন।
জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান প্রথম আলোকে বলেন, সৈকতে এখন লাখো পর্যটকের সমাগম ঘটছে। অভিযোগ গ্রহণ ও সেবা নিশ্চিতে সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে আরও কয়েকটি তথ্য ও অভিযোগকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তুতি চলছে।
কেন্দ্রটি তত্ত্বাবধান করেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবু সুফিয়ান। তিনি বলেন, লাস্ট স্টপেজ হওয়ায় বিপুলসংখ্যক পর্যটক বাস থেকে কলাতলী মোড়ে নামেন। তাঁরা যেন শুরুতেই হয়রানির স্বীকার না হন, সে জন্য মোড়ে অভিযোগকেন্দ্র করা হয়েছে। পর্যটকেরা কক্সবাজারের কোথায়, কীভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন—সব তথ্যকেন্দ্র থেকে পাচ্ছেন।
কেন্দ্রটিতে দেখা গেছে, ভেতরে অভিযোগ গ্রহণ করছেন দুই বিচকর্মী। সেখানে চেয়ারে বসে আছেন কয়েক পর্যটক। তাঁদের কেউ মেরিন ড্রাইভ দিয়ে টেকনাফ যেতে চান, আবার কেউ বুকিং করা হোটেলের সন্ধান চাইছেন। বিচকর্মীরা তাঁদের বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন। কেন্দ্রের ভেতর বড় ব্যানারে জেলার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানের ছবি। সমুদ্রে গোসলে নামার আগে কী করতে হবে, সেই নির্দেশনাসংবলিত লিফলেট রাখা আছে টেবিলে। শহরের অধিকাংশ হোটেল-গেস্টহাউস-রিসোর্টের যোগাযোগের নম্বর, জোয়ার-ভাটা সম্পর্কিত প্রদর্শনী বোর্ড, মুঠোফোন চার্জিং ও ওয়াই–ফাই সুবিধা আছে কেন্দ্রটিতে।
কেন্দ্রের ইনচার্জ ও জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাসুম বিল্লাহ বলেন, মূলত কক্সবাজারে আগত পর্যটকদের স্বাগত জানানো ও সেবা নিশ্চিত করতে তথ্যকেন্দ্রটি খোলা হয়েছে। চার দিনে বেশ সাড়া মিলেছে। দুর্ভোগ-হয়রানির প্রতিকার পেয়ে পর্যটকেরাও খুশি। ২০ পর্যটক নানা ঘটনায় লিখিত অভিযোগ করার সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগের সুরাহা করা হয়।
সৈকত ভ্রমণে এসে কোনো পর্যটক হয়রানির শিকার হলে জেলা প্রশাসনের নিচের নম্বরে যোগাযোগ করার নির্দেশনা আছে। লাবণী পয়েন্ট ০১৮৯৩৩৯৮৯৮৮, সুগন্ধা পয়েন্ট ০১৮৯৩৩৯৮৯৯০, কলাতলী পয়েন্ট ০১৮৯৩৩৯৮৯৯২, ইনানী বিচ ০১৮৯৩৩৯৮৯৯৪ এবং সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ০১৮৯৩৩৯৮৯৯৬।