নোয়াখালীতে মারধরে নিহত যুবলীগ নেতা মো. আবদুস শহীদকে (৪৩) হত্যার আগে তাঁর বাড়ির সামনে হামলাকারীরা পাহারা বসিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন নিহত মো. আবদুস শহীদের বড় ভাই নুরুল আমিন। বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নুরুল ইসলাম ও তাঁর লোকজন ঘটনার দিন শহীদকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যান বলেও তিনি দাবি করেন।
গত শনিবারের এই হত্যাকাণ্ডের পর অভিযুক্ত নুরুল ইসলাম ওরফে মিয়া মাঝি ও তাঁর সহযোগীরা পালিয়ে গেছেন। এরপরও শহীদের পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে জানান তাঁর বড় ভাই নুরুল আমিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘হামলাকারী আমাদের বাড়ির সামনে পাহারা বসিয়েছেন, যাতে আমরা কেউ বাড়ি থেকে বের হতে না পারি। আমার ভাইকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যান নুরুল ইসলাম ওরফে মিয়া মাঝি ও তাঁর ছেলে জাবেদসহ তাঁদের লোকজন। মারতে মারতে তাঁকে একই এলাকার একটি বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নির্মাণাধীন পাকা দালানের একটি কক্ষে আটকে হাত-পা বেঁধে নির্মমভাবে পেটানো হয়।’
নিহত আবদুস শহীদ নোয়াখালী সদর উপজেলার ১৯ নম্বর পূর্ব চর মুটয়া ইউনিয়নের সূর্য নারায়ণবহর গ্রামের মমিন উল্যাহর ছেলে। ছোট ভাইকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা তুলে ধরেতে গিয়ে বড় ভাই নুরুল আমিন আরও বলেন, ‘আমার ভাই ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সহসভাপতি ছিলেন। দুই বছর আগেও আমার ভাইকে মিয়া মাঝির লোকজন তুলে নিয়ে নির্মমভাবে মেরেছিল। কুপিয়ে পুরো শরীর ক্ষতবিক্ষত করেছিল। কিন্তু সে যাত্রায় সে বেঁচে যায়।’
নুরুল আমিন বলেন, ‘গত শনিবার মিয়া মাঝি ও তাঁর ছেলে জাবেদসহ তাদের লোকজনের মারধরে শহীদ গুরুতর আহত হন। ওই অবস্থায় তাঁরা গণপিটুনির নাটক সাজিয়ে অস্ত্র দিয়ে আমার ভাইকে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কাছে তুলে দেন। পরে হাসপাতালে আমার ভাই মারা যান।’
নুরুল আমিন আরও বলেন, ‘আমরা আট ভাই। প্রত্যেকের বাড়ির সামনে তাঁরা পাহারা বসিয়েছিলেন, যাতে আমরা কেউ বাড়ি থেকে বের হতে না পারি। ভাইকে হারিয়ে আজ চার দিন ধরে নাওয়া-খাওয়া নেই। আমরা এই ঘটনার বিচার চাই। ভাইয়ের দুই প্রতিবন্ধী সন্তানসহ পরিবারকে যাঁরা পথে বসিয়েছেন, তাঁদের শাস্তি চাই।’
গত রোববার বিকেলে ময়নাতদন্ত শেষে হাসপাতালের মর্গ থেকে নিহত শহীদের লাশ গ্রহণ করেছিলেন তাঁর স্ত্রী ফাতেমা আক্তার ও বড় ভাই নুরুল আমিন। পরে বাদ আছর জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়।
ফাতেমা বেগমা বলেন, তাঁর দুই ছেলে, এক মেয়ে। এর মধ্যে এক ছেলে ও এক মেয়ে প্রতিবন্ধী। হামলাকারীরা সেদিন তাঁর স্বামীকে তুলে নিয়ে মেরে ফেলার পাশাপাশি তাঁদের বসতঘরে হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়ে সব জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিয়া মাঝি একসময় বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল। তিনি বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৭ নম্বর ওয়ার্ড থেকে সদস্য প্রার্থী হয়ে পরাজিত হয়েছিলেন। আর নিহত শহীদ ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সহসভাপতি ছিলেন। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মিয়া মাঝির নেতৃত্বে স্থানীয় ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউপি সদস্য তোফায়েল আহমদের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। দফায় দফায় হামলা ও সশস্ত্র মহড়ার একপর্যায়ে তোফায়েল এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে চলে যান।
প্রসঙ্গত, শনিবার বিকেলে বিকেলে পূর্ব চর মটুয়া এলাকায় শহীদ নামের এক অস্ত্রধারী ও তাঁর অপর তিন সহযোগীকে আটক করা হয়েছে বলে যৌথ বাহিনীর কাছে খবর পাঠানো হয়। এই চারজন হলেন আবদুস শহীদ, মো. জামাল, মো. জাবেদ ও মো. রিয়াদ। খবর পেয়ে সেনাবাহিনীর ১৬ রেজিমেন্ট আর্টিলারি ক্যাপ্টেন ইফতেখার আহমেদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী ও পুলিশ যৌথ অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে আটক ওই চার ব্যক্তিকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এ সময় একটি শটগান জব্দ করা হয়। যৌথ বাহিনী আহত চারজনকে হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত আটটার দিকে শহীদ মারা যান। অন্য তিনজন একই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
সুধারাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মীর জাহেদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এবং সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এরই মধ্যে একাধিকবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। প্রত্যক্ষদর্শী এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ ঘটনার বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি। এরপরও ভাইরাল হওয়া ভিডিওচিত্র দেখে এবং গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের কয়েকজনের নাম-পরিচয় সংগ্রহ করা হয়েছে। তাঁদের সবাই এখন এলাকা ছাড়া। গ্রেপ্তারে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।