হামলা-মামলায় বাড়ি ছেড়েছিলেন তাঁরা, চার মাস পর ফিরে দেখলেন ধ্বংসস্তূপ
তিন বছর আগে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন ঘিরে দ্বন্দ্বের শুরু। গত জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দ্বন্দ্ব আরও তীব্রতর হয়। আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে ভোট না দেওয়ায় রোষানলে পড়ে গ্রামটির প্রায় দেড় শ পরিবার। তাদের ওপর শুরু হয় অত্যাচার ও নির্যাতন। গত এপ্রিলে দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত হন এক যুবলীগের কর্মী। হামলা-মামলায় জর্জরিত হয়ে বাড়ি ছাড়ে ১৪৪টি পরিবার।
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর নিজ গ্রামে ফিরেছে ওই পরিবারগুলো। বাড়ি ছাড়ার সময় তারা কিছুই নিতে পারেনি। বাড়িতে এসে তারা কেবল ভিটেমাটিই পেয়েছে। বাড়ির সব আসবাব ও মালপত্র লুট হয়েছে। বাড়ির দরজা-জানালাও খুলে নিয়ে গেছে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে বসতভিটা।
ঘটনাটি ঘটেছে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার সাহাপুর ইউনিয়নের চরগড়গড়ি পশ্চিমপাড়া গ্রামে। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো এখন নিঃস্ব। মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে ফেলেছে। এখন তাদের খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে হচ্ছে।
ভুক্তভোগী পরিবার ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চরগড়গড়ি গ্রামে প্রায় সাত হাজার মানুষের বসবাস। গ্রামটি উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমপাড়ায় বিভক্ত। তিন বছর আগে সাহাপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সহসভাপতি খাইরুল ইসলাম ইউপি নির্বাচনে সদস্য পদে প্রার্থী হয়ে পরাজিত হন। চরগড়গড়ি পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দারা বিএনপির সমর্থক হিসেবে পরিচিত। গত জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় খাইরুল ইসলাম ও তাঁর সহযোগীরা তাঁদের ওপর নির্যাতন শুরু করেন। ১৯ এপ্রিল দুই পক্ষের সংঘর্ষে খাইরুল ইসলাম নিহত হন। গ্রামের লোকজনকে আসামি করে মামলা হয়। একদিকে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের হামলা, অন্যদিকে পুলিশের অভিযান শুরু হয়। পরে বসতবাড়ি ছেড়ে যায় চরগড়গড়ি পশ্চিমপাড়ার ১৪৪টি পরিবার। প্রতিটি বাড়ি থেকে প্রথমে গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি, আসবাবপত্র, রান্নার সরঞ্জাম, বিভিন্ন ফসলসহ সব মালপত্র লুট করা হয়। এরপর পাকা ভবনের দরজা-জানালা ও ঘরের টিন খুলে নেওয়া হয়। দীর্ঘ সময় ধরে লুটতরাজ চলে গ্রামটিতে। বিষয়টি থানায় জানানো হলেও পুলিশ খোঁজখবর নেয়নি। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পরিবারগুলো গ্রামে ফিরতে শুরু করেছে।
ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন, সাহাপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর যুবলীগের সহসভাপতি জহুরুল ইসলাম, চরগড়গড়ি গ্রামের বাসিন্দা ও সাহাপুর ইউপির সদস্য মিলন প্রামাণিক এবং পাশের লক্ষ্মীকুণ্ডা ইউপির সদস্য আসাদুল ইসলাম ও তারিকুল ইসলামের নেতৃত্বে হামলা ও লুটপাট করা হয়। তাঁরা পাবনা-৪ (ঈশ্বরদী-আটঘরিয়া) আসনের সাবেক সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গালিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সাবেক সংসদ সদস্যের নাম ভাঙিয়ে এলাকায় বিভিন্ন অপকর্ম করতেন।
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর অভিযুক্ত ব্যক্তিরা এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে গেছেন। আওয়ামী লীগের নেতারা এলাকা ছেড়েছেন। হামলায় অভিযুক্ত স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ও সাহাপুর ইউপির সদস্য মিলন প্রামাণিক বলেন, ‘হামলার সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম না। তবে ওই সময় আমাদের কিছুই করার ছিল না। যারা হামলা চালিয়েছে, তারা সশস্ত্র ছিল। আমরা বাধা দিলে নিজেরাই খুন হয়ে যেতাম।’
গত শনিবার দুপুরে চরগড়গড়ি পশ্চিমপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, কিছু বাড়িতে পাকা ভবন দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু দরজা-জানালা নেই। টিনের বাড়িঘরের কিছু আর অবশিষ্ট নেই। নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে নলকূপ। কেটে নেওয়া হয়েছে গাছপালা। বাড়িতে ফিরে হাহুতাশ করছেন পরিবারের সদস্যরা।
বসতবাড়ির সবকিছু হারিয়েছেন দোয়াত প্রামাণিক (৬৫)। তিনি বলেন, ভোটের পর আওয়ামী লীগের নেতারা পরিকল্পিতভাবে গ্রামটিতে সহিংস পরিস্থিতি তৈরি করেন। একের পর এক হামলা করা হয়। সংঘর্ষে একজন নিহত হওয়ার পর প্রথমে পুরুষেরা বাড়ি ছাড়েন। পরে হামলা চালিয়ে নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ সবাইকে বাড়িছাড়া করা হয়। এখন সবাই নিঃস্ব ও পথের ফকির।
আমাগের সাথে কারও বিরোধ ছিল না, ওরা অকারণে বিরোধ বাধাইছে। হামলা করে আমার হাত কাটে পঙ্গু বানাইছে। বাড়িঘরের সব লুটে নিয়ে গেছে।ইসাহাক প্রামাণিক, হামলায় আহত ব্যক্তি
হামলায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন ইসাহাক প্রামাণিক নামের এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, ‘আমাগের সাথে কারও বিরোধ ছিল না, ওরা অকারণে বিরোধ বাধাইছে। হামলা করে আমার হাত কাটে পঙ্গু বানাইছে। বাড়িঘরের সব লুটে নিয়ে গেছে। আমরা ইয়ের বিচের চাই।’
গ্রামের বাসিন্দা কলেজশিক্ষার্থী শামীম হোসেন বলেন, সন্ত্রাসীরা শুধু লুটপাট করেই ক্ষান্ত হয়নি; শিক্ষার্থীদেরও স্কুল-কলেজে যেতে দেয়নি, পরীক্ষা দিতে দেয়নি। যেখানে যাকে দেখেছে, সেখানেই মারধর করেছে।
এ বিষয়ে পাবনা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘চরগড়গড়ি পশ্চিমপাড়ার মানুষের একটাই অপরাধ, তারা বিএনপির সমর্থক। তাদের ওপর যে নির্যাতন করা হয়েছে, তা মানবতাবিরোধী অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। নতুন সরকারের কাছে আমি এই নৃশংসতার বিচার ও ক্ষতিপূরণ দাবি করছি।’
পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাসুদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ঘটনাটি শুনেছি। ইতিমধ্যে অভিযোগ গ্রহণ করে থানা-পুলিশকে আইনগত ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ঘটনায় কোনো পুলিশ কর্মকর্তার গাফিলতি ও দোষ প্রমাণিত হলে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’