বিনা দাওয়াতের আয়োজন, এককাতারে বসে খান হাজারো ধনী-গরিব
সাদামাটা ‘ভাত-সালুনের’ আয়োজন। কিন্তু এই সাধারণ-সহজ ভোজেই সমাবেশ ঘটেছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা, জাত-ধর্মের অনেক মানুষের। দরিদ্র-বিত্তবান পাশাপাশি বসেই দিনভর খোলা মাঠে খাওয়াদাওয়া করেছেন। সব শ্রেণি ভেদাভেদ, দূরত্ব ঘুচিয়ে এককাতারে শামিল হয়েছেন সবাই। প্রায় হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ সংস্কৃতির অংশ ‘রাঘাটি শিরনি’ সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সাম্যের এক অনন্য আয়োজন।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মোস্তফাপুর ইউনিয়নের রাস্তার সামনের মাঠে গতকাল রোববার ছিল এই আয়োজন। সদর উপজেলার ভুজবল কপালিবাড়ির উদ্যোগে এই শিরনির আয়োজন করা হয়। সাদা ভাত, লাউ দিয়ে মোরগের মাংসের তরকারির ভোজে অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন স্থান থেকে আসা প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষ।
মোস্তফাপুরের বাবুল আহমদ বলেন, ‘সব সময় ফেসবুকে দেখতাম এই শিরনি হয়েছে। কিন্তু কোনো বছরই আর আসা হয়নি। এবারই প্রথম খেতে এলাম। খুব সুন্দর পরিবেশে খাওয়াদাওয়া করছি। খেয়ে খুব তৃপ্তি পাইছি। হিন্দু-মুসলমান নানা ধরনের মানুষ আসছেন, খেয়েছেন। আয়োজনটি খুব ভালো লাগছে।’
বাহারমর্দান গ্রামের তোফায়েল আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেশ কয় বছর ধরে সুন্দর পরিবেশে খোলা মাঠে শিরনি হচ্ছে। স্থানীয় মানুষ ছাড়াও অটোরিকশা, রিকশা, গাড়ি করে অনেক মানুষ আসেন।’
গতকাল দুপুরে দেখা গেছে, শিরনির স্থানের খোলা মাঠে চলছে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন। আমন ধান কেটে নেওয়া হয়েছে। মাঠে পড়ে আছে ধূসর নাড়া। সেই নাড়ার মধ্যেই প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে রাখা আছে। লোকজন আসছেন। নির্দিষ্ট স্থান থেকে প্লেটে করে খাবার নিয়ে কেউ চেয়ার বসে, কেউ নাড়ার মধ্যেই আসন পেতে খাওয়াদাওয়া করছেন। এই শিরনি খেতে শুধু আশপাশের গ্রামই নয়, বিভিন্ন স্থান থেকে নানা বয়সের প্রচুর লোকজন এসেছেন। মাঠের পাশে পাকা সড়কে অনেকগুলো সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, রিকশাসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন দাঁড়িয়ে আছে। নারী-পুরুষ, শিশুসহ অনেকেই অংশ নিয়েছেন এই ভোজে। খাওয়া শেষ করে কেউ চলে যাচ্ছেন, নতুন করে আসছেন অনেকে। এই আসা-যাওয়ার মধ্যেই দিনভর খাওয়াদাওয়া চলেছে। যে–ই আসছে, তাকেই খেতে দেওয়া হচ্ছে। এখানে কে অতিথি, কে আমন্ত্রিত—এ রকম কোনো ব্যবস্থা নেই। যে আসছে, তাকেই খাবার দেওয়া হয়েছে।
গয়ঘরের মো. আমির প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভুজবল-গয়ঘরের তিন রাস্তার মুখে এই রাঘাটি শিরনিতে আমি প্রতিবছরই আসি। অনেক মানুষের সমাবেশ ঘটে। মানুষ আনন্দ-উৎসাহের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করেন। এখানে সবাই সমান।’
শিরনিতে উপস্থিত সালেহ এলাহী কুটি বলেন, ‘রাঘাটি শিরনি মূলত শীতের সময় অগ্রহায়ণ মাসের ধান কাটার পর করা হয়ে থাকে। ধান কাটা শেষে অবসর সময়ে সবাই মিলে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির মধ্যে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করেন। প্রত্যাশা থাকে, সামনের বছর মাঠে যেন আরও ভালো ফসল ফলে।’
আয়োজক ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ভুজবল কপালিবাড়ির উদ্যোগে রাঘাটি শিরনির আয়োজন হয়ে আসছে। গত শনিবার বাজারসদাই করা হয়েছে। গতকাল ভোর রাতেই চাল, তরিতরকারির জিনিসপত্র, মসলাপাতি—সবকিছু মাঠে নিয়ে আসা হয়েছে। ভোর থেকেই বাবুর্চি মাঠে রান্নাবান্না শুরু করেন। অনেক হাঁড়িতে রান্না হয়েছে। সকাল ৯টার মধ্যে রান্না শেষ করে ভোজের জন্য প্রস্তুত করা হয়। বেলা ১১টা থেকে খাওয়া শুরু হয়েছে। যত সময় তরকারি ছিল, তত সময় লোকজন খেয়েছে। বিকেল প্রায় চারটা পর্যন্ত এই খাওয়াদাওয়া চলেছে। এ আয়োজন একটি পরিবারের উদ্যোগে হলেও প্রতিবেশীসহ অনেকেই স্বেচ্ছায় ব্যবস্থাপনার কাজ করেন।
উদ্যোক্তা পরিবারের জুনেদ আবেদীন বলেন, ২০১৩ সাল থেকে রাঘাটি শিরনির আয়োজন করা হচ্ছে। একটি ভিডিওতে সিলেট অঞ্চলে রাঘাটি শিরনির ঐতিহ্যের বিষয়টি তাঁর চোখে পড়ে। তখন তাঁর মনে পড়ে শৈশবে তাদের এলাকাতেও অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটার পর এ রকম একটি শিরনি হতো। তবে সেটি ছিল ক্ষীরের শিরনি। কিন্তু এখন সেই ক্ষীরের শিরনিও হয় না। তিনি তাঁর পরিবারের সবার সঙ্গে আলাপ করে এ রকম একটি শিরনির আয়োজন করা যায় কি না, তা নিয়ে কথা বলেন। পরিবারের সবাই সম্মতি দিলে শুরু হয় স্থানীয়ভাবে রাঘাটি শিরনি। আয়োজনে অনেকে আর্থিকভাবে যুক্ত হতে চেয়েছেন। তবে পারিবারিকভাবেই এখনো সব খরচ বহন করেন তাঁরা। এখানে কাউকে ব্যক্তিগতভাবে দাওয়াত দেওয়া হয় না। শুধু শিরনির দিনটি স্থানীয় মসজিদের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়। তাঁরা ঘর থেকে চাল দেন। নগদ অন্যান্য খরচ হয়েছে প্রায় এক লাখ টাকা।