গরিবের গোশতে ভাগ বসাচ্ছেন হোটেলমালিকেরা

কোরবানির ঈদে কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে গোশতের অস্থায়ী হাট বসে। যাঁরা কোরবানি করতে পারেন না, তারা কম দামে সেখান থেকে গোশত কেনেন। গোশত কেনার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন কয়েকজন ক্রেতা। ঈদের দিন দুপুরেছবি: প্রথম আলো

কুমিল্লার প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ে সারা বছর যানজট ও গাড়ির হর্ন শোনা গেলেও সোমবার ঈদের দিন ফাঁকা পাওয়া গেল। যেটুকু ভিড়ভাট্টা, সেটাও অস্থায়ী একটি গোশতের হাটের জন্য। কোরবানির ঈদের পর যাঁরা বাড়িতে বাড়িতে গোশত সংগ্রহ করেন, তাঁরা হাটের বিক্রেতা।

নিম্নমধ্যবিত্ত যাঁরা কোরবানি করতে পারেননি, তাঁরা এই গোশতের ক্রেতা। অস্থায়ী এই হাটে ওজন করে গোশত বিক্রি হয় না। হাতে ধরে অনুমান করে গোশত বিক্রি করেন বিক্রেতারা। ক্রেতারাও অনুমান করে দরদাম করে কেনেন।

অল্প দামে গোশত কিনতে হাতে ব্যাগ নিয়ে পূবালী ব্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন কুমিল্লা ইপিজেডে চাকরি করা মো. মোস্তাফিজ। থাকেন কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার বালুতুপা এলাকায়। দুপুরে বাসা থেকে একমাত্র মেয়েকে বলে এসেছেন, গরুর গোশত কিনতে যাচ্ছেন। স্ত্রীকে রান্নার আয়োজন করতে বলেছেন। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়েও গোশত কিনতে পারেননি।

মোস্তাফিজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যারা কোরবানি দিতে পারি না, তাঁরা কান্দিরপাড়ে এসে কম দামে গোশত কিনি। কিন্তু কয়েক বছর এখানে এসে কম দামে গোশত কিনতে পারি না। ছোট ছোট হোটেলের মালিকেরা এখানে এসে গোশত কেনেন। তাঁরা গোশত কিনে ফ্রিজে (রেফ্রিজারেটর) রেখে পরে রান্না করে বিক্রি করেন। এ জন্য দাম বেড়ে যায়। গরিবের গোশতে তাঁরা ভাগ বসাচ্ছেন।’

নাম না প্রকাশ করার শর্তে কয়েকটি হোটেলের মালিক বলেন, বাজার থেকে গোশত কিনলে প্রতি কেজিতে আড়াই শ গ্রাম হাড্ডি দেয়। এ ছাড়া গোশতের সঙ্গে অনেক চর্বি নিতে হয়। এখন কেজিপ্রতি ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা পড়ে। এ জন্য এখানে গোশত নিতে আসেন।

দুপুরের পর থেকে কান্দিরপাড়ে গোশতের ক্রেতার সংখ্যা বাড়তে থাকে। তাঁদের অনেকেই নিম্নমধ্যবিত্ত। কেউবা নিম্নবিত্ত। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে কোরবানি করতে পারেননি। তাই কম দামে গোশত কিনতে এসেছেন।

দুপুর ১২টায় বের হয়ে বেলা ২টা পর্যন্ত বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে গোশত সংগ্রহ করেছেন হৃদয়। রংমিস্ত্রির কাজ করেন। থাকেন ইপিজেডের পকেট গেট এলাকায়। বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ঘরে মা ছাড়া কেউ নেই। আজ ঈদের দিন। হাতে কাজ না থাকায় বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে গোশত সংগ্রহ করে তিন কেজির মতো গোশত পেয়েছেন। অর্ধেক বিক্রি করেছেন। বাকি অর্ধেক বাড়িতে নিয়ে যাবেন।

হৃদয় বললেন, ‘সকালে ঈদের নামাজ পড়েছি। মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে বের হইছি। মারে কইছি মাংস আনতাম যাই। ঘরে তেল আছে। কিন্তু মসলা নাই। রাজগঞ্জে যাইতাছি। অর্ধেক গোশত বেইচ্চা যেই টাকা পাইছি, হেইডা দিয়া মসলা কিনমো। বাহি গোশতটাডারে রানতে কমু মারে।’

নগরের টমছমব্রিজ এলাকা থেকে গোশত কিনতে এসেছেন সুরাইয়া বেগম। নগরের একটি হাসপাতালে আয়ার কাজ করেন। বছর দুয়েক আগে সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামী মারা গেছেন। তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে। সেই থেকে বহু কষ্টে ছেলেমেয়েদের নিয়ে খেয়ে না–খেয়ে বেঁচে আছেন। কান্দিরপাড়ে দীর্ঘ এক ঘণ্টারও বেশি সময় অপেক্ষা করে দেড় কেজির মতো গোশত পেয়েছেন।

সুরাইয়া বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলেটা একটু বড় হয়েছে। অনেক কিছু বোঝে। মেয়েটা ছোট। মেয়েটা সকালে বলে, মা গোশত দিয়ে ভাত খাব। তখন মানুষ মাত্র কোরবানি শুরু করছে। কই পাব গোশত! সবজি দিয়ে ভাত দিয়েছি। খেতে চায় না। ওর বাবা থাকতে মাঝেমধ্যে গোশত খেতে পারতাম। এখন তা-ও পারি না। আজ ঈদ। এই দেড় হাজার টাকা জমিয়ে রাখছিলাম। তাই নিয়ে গোশত কিনতে এসেছি। কান্দিরপাড়ে কম দামে গোশত কিনতে পারছি। এখন বাসায় গিয়ে গোশত রান্না করে মেয়ের পাতে তুলে দিতে পারলে শান্তি লাগবে।’