বাকেরগঞ্জে চরাঞ্চলের অনাবাদি জমিতে তরমুজের বাম্পার ফলন
সোহরাফ হোসেনের বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতি এলাকায়। আগে টুকটাক ঠিকাদারি করে সংসার চালাতেন। তিন বছর ধরে ব্যবসার পাশাপাশি তরমুজ চাষ করে বেশ লাভবান হয়েছেন। গত বছর ৩৭ একর জমিতে তরমুজের আবাদ করেছিলেন। এবার আরও ১১ একর জমি বাড়িয়েছেন। এর মধ্যে বাকেরগঞ্জের ভরপাশা ইউনিয়নের দুধল মৌ এলাকায় পায়রা নদীর তীরে ১১ একর জমি রয়েছে। ফলন বেশ ভালো। এ ছাড়া ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলায়ও ৩৭ একরের তরমুজখেত রয়েছে তাঁর।
সোহরাফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এসব জমিতে তরমুজের আবাদ করতে এবার ব্যয় হয়েছে প্রায় ৬০ লাখ টাকা। এরই মধ্যে প্রায় ৫ একর জমির তরমুজ বিক্রি করে আয় করেছেন ১৫ লাখ টাকা। এখনো সব তরমুজ পরিপক্ব হয়নি। আরও কয়েক দিন লাগবে। আশা করছেন ৮০ থেকে ৮৫ লাখ টাকা বিক্রি করতে পারবেন।
এবার বাকেরগঞ্জ উপজেলার পায়রা, তুলাতলী, কারখানা নদীর চরের অনাবাদি জমিতে তরমুজ আবাদ করে মুখে হাসি ফুটেছে চাষিদের। বাম্পার ফলন ও ভালো দাম পাওয়ায় লাভবান হচ্ছেন তাঁরা। দেশের বিভিন্ন স্থানের পাইকারেরা এসব খেত থেকে তরমুজ কিনে ট্রলার বা ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছেন রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, বাকেরগঞ্জের বিভিন্ন ইউনিয়নের চরাঞ্চলে জমি সারা বছর অনাবাদি থাকত। বছরে একবার আমন ধানের আবাদ হলেও ফলন ছিল কম। পরিবহন ব্যবস্থা ভালো থাকায় উপজেলার ভরপাশা, গারুড়িয়ার, ফরিদপুর, রঙ্গশ্রী ও দুর্গাপাশা ইউনিয়নের চরাঞ্চলের প্রায় ৬০০ হেক্টর পরিত্যক্ত জমিতে ব্যাপকভিত্তিক তরমুজ আবাদ শুরু করেন কৃষকেরা। ভিক্টর সুগার, ওশেন সুগার, ব্ল্যাকবেরি ও দেশি জাতের এসব তরমুজ আকারে বড় ও আগাম উৎপাদন হয়।
পটুয়াখালী থেকে বাকেরগঞ্জে এসে স্থানীয় ব্যক্তিদের কাছ থেকে পাঁচ একর জমি লিজ নিয়ে তরমুজ চাষ করেছেন চাষি শামিম মিয়া ও সাইফুল ইসলাম। দেড় একরের একটি খেতের তরমুজ ৩ লাখ ৮৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। আরও সাড়ে ৩ একরের জমিতে চাষ করা তরমুজ ১৫ দিন পর বিক্রি করা যাবে। তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় তাঁদের খেতে ফলন ভালো হয়েছে।
পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলার আমখোলা ইউনিয়নের আলাউদ্দিন মৃধা, নিজাম উদ্দীন, মো. মোস্তফা, মুছা বয়াতি, শামিম হোসেন, জুয়েল মিয়া এবং বাকেরগঞ্জের সোহরাব হোসেন, সাইফুল ইসলাম—এবারই প্রথম জমি লিজ নিয়ে আগাম জাতের তরমুজ আবাদ করেন।
এসব চাষি বলেন, ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে পটুয়াখালী জেলা থেকে আসা শতাধিক কৃষক পরীক্ষামূলক ভরপাশা ইউনিয়নের পায়রা নদীর চরে, গারুড়িয়ার ইউনিয়নের তুলাতলী নদীর চরে, রঙ্গশ্রী ইউনিয়নে বোয়ালিয়ার চরে, ফরিদপুর ইউনিয়নে কারখানা নদীর চরে ও দুর্গপাশা ইউনিয়নের চরাঞ্চলে তরমুজ চাষ করেন।
এসব ইউনিয়নের চরাঞ্চলে গিয়ে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে তরমুজ ফলেছে। কোনো কোনো মাঠে আগাম জাতের তরমুজ তোলা হচ্ছে। আবার অনেক খেতে তরমুজ তুলতে বেশ কযেকদিন সময় লাগবে।
ভরপাশা ইউনিয়নের তরমুজচাষি আলাউদ্দিন মৃধা ও সোহরাব মৃধা বলেন, বাকেরগঞ্জে এ বছর উৎপাদিত তরমুজের আকার বড় হয়েছে। এখন মাঠে ৮-১০ কেজি ওজনের তরমুজ রয়েছে। ১৫ দিন ধরে মাঠ থেকে তরমুজ বিক্রি হচ্ছে। পাইকারদের মাধ্যমে এসব তরমুজ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে।
পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার আমখোলা ইউনিয়ন থেকে তরমুজ চাষ করতে আসা কৃষকেরা খেতের মধ্যেই ‘টংঘর’ করে সেখানে থাকছেন। এভাবে তরমুজখেতের নজরদারি ও পরিচর্যা করছেন জানিয়ে তাঁরা বলেন, বাকেরগঞ্জে এবার পটুয়াখালীর শতাধিক চাষি তরমুজ চাষ করতে এসেছেন।
বাকেরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুনীতি কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, আবহাওয়া অনুকূল থাকলে তরমুজ চাষে ঝুঁকি কম। সময়ও কম লাগে। ভালো ফলনের কারণে চাষিরা লাভবান হওয়ায় ভবিষ্যতে তরমুজের আবাদ আরও বাড়বে। খরা ও লবণাক্ততা কৃষিতে যখন অশনিসংকেত হয়ে দেখা দিয়েছে, তখন তরমুজের আবাদ বাড়ার বিষয়টি ইতিবাচক।
বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিভাগে তরমুজ আবাদ হয়েছিল ৩৬ হাজার ৯১১ হেক্টর জমিতে। ২০২০-২১ মৌসুমে আবাদ কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৩৪ হাজার ৬৮৮ হেক্টরে। এরপর ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে হয় ৪৬ হাজার ৪৫১ হেক্টর।
চলতি মৌসুমে আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। এ বছর বিভাগে তরমুজের আবাদ হয়েছে ৬৪ হাজার হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি তরমুজ আবাদ হয়েছে পটুয়াখালী (২৮ হাজার হেক্টর), ভোলা (১৮ হাজার হেক্টর) এবং বরগুনা জেলায় (১৫ হাজার হেক্টর)। এ ছাড়া বরিশাল জেলা ১ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছে।
বরিশাল বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক শওকত ওসমান প্রথম আলোকে বলেন, এবার সব জায়গায়ই তরমুজের ফলন ভালো হয়েছে। এরই মধ্যে আগাম জাতগুলো বাজারে আসছে। তবে মৌসুমের তরমুজ পুরোপুরি বাজারে আসতে আরও দেড় মাস সময় লাগবে।