বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
উপাচার্যের বাসভবনের ফটক ভাঙচুরের ঘটনায় থানায় অভিযোগ, ৫ দাবিতে শিক্ষার্থীদের আলটিমেটাম
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শুচিতা শরমিনের বাসভবনের মূল ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে বিক্ষোভ করার ঘটনায় থানায় অভিযোগ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। গতকাল শনিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার (নিরাপত্তা) সানোয়ার পারভেজ বাদী হয়ে ১৭ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা ২০ থেকে ২৫ জনের বিরুদ্ধে বন্দর থানায় অভিযোগটি করেন।
বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করে রোববার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, মামলাটি এজাহার হিসেবে এখনো নথিভুক্ত হয়নি। তবে প্রক্রিয়া চলছে।
এদিকে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দেওয়ার ঘটনায় আজ সকাল থেকে ক্যাম্পাসে জড়ো হয়ে তাঁরা প্রতিবাদ জানান। দুপুরে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের নিচতলায় সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ বা মামলা প্রত্যাহারের পাশাপাশি নতুন করে পাঁচ দফা দাবি ঘোষণা করেন। এ সময় অভিযোগ প্রত্যাহারে ছয় ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন শিক্ষার্থীরা। তবে সন্ধ্যা ছয়টা আলটিমেটামের সময় শেষ হলেও কর্তৃপক্ষ অভিযোগ প্রত্যাহার করেনি।
উপাচার্য শুচিতা শরমিনের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট থেকে দুজন শিক্ষক প্রতিনিধিকে বিধিবহির্ভূতভাবে বাদ দেওয়া ও ফ্যাসিবাদীদের পুনর্বাসনের অভিযোগ তুলে গত বৃহস্পতিবার আকস্মিক ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেন শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। তাঁরা উপাচার্যের কার্যালয়ের কলাপসিবল গেট ও বাসভবনের মূল ফটকে তালা দেন। পরদিন শুক্রবার বিকেলে উপাচার্যের বাসভবনে পূর্বনির্ধারিত সিন্ডিকেটের জরুরি সভা ডাকলে বাতিলের দাবিতে তাঁর বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে তাঁরা বাসভবনের মূল ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে বিক্ষোভ করেন। উপাচার্যের অভিযোগ, তাঁর বাসভবনের মূল ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে ২০-২৫ জন শিক্ষার্থী বুলডোজার দিয়ে বাসভবন গুঁড়িয়ে ফেলা ও আগুন দেওয়ার হুমকি দেন।
আজ শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন করে পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরেন। দাবিগুলো হলো শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে করা ষড়যন্ত্রমূলক মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে; সিন্ডিকেট সদস্যদের নাম প্রকাশ ও আওয়ামী ফ্যাসিবাদীদের বাদ দিয়ে শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে; রেজিস্ট্রারসহ উপাচার্য দপ্তরের সব ফ্যাসিবাদী সদস্যকে অপসারণ করতে হবে; ছাত্র সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ঘোষণা ও আন্দোলনে হামলাকারী ছাত্রলীগের কর্মীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে; বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন, আবাসনসংকট নিরসনসহ আগের দাবিগুলোর অগ্রগতি ১২ ঘণ্টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের জানাতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী মোকাব্বেল শেখ বলেন, ‘আমরা দাবি নিয়ে উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছি। কিন্তু তিনি আমাদের সঙ্গে বসেননি। বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্টদের বাদ দিতে বললে তিনি করেননি। সিন্ডিকেটের এজেন্ডা না জানিয়ে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের জন্য গোপন সিন্ডিকেট ডাকেন। তিনি আমাদের দাবি না মেনে বাইরের আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্টদের যুক্তি ও পরামর্শে তিনি এসব কাজ করছেন।’
ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী মোশাররফ হোসেন বলেন, শিক্ষার্থীদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল উন্নয়নকাজের প্রতিফলন ঘটুক। উপাচার্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করবেন। অথচ তিনি ফ্যাসিবাদীদের পুনর্বাসন করার চেষ্টা করছেন। আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনে ভুলত্রুটি হতে পারে। একজন অভিভাবকতুল্য উপাচার্য কীভাবে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, তিনি ফ্যাসিবাদীদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করছেন। অবিলম্বে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
এদিকে শিক্ষার্থীদের সংবাদ সম্মেলনের পর উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে দুপুরে নিজ কার্যালয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন উপাচার্য শুচিতা শরমিন। তিনি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পেছনে সহ–উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ ও ইংরেজি বিভাগের এক অধ্যাপককে দায়ী করেছেন। উপাচার্য শুচিতা শরমিন বলেন, ‘আমি ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসন করছি, এমন গুজব উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছড়ানো হয়েছে। এর পেছনে কয়েকজন স্বার্থান্বেষী শিক্ষকসহ তিনজন ব্যক্তি জড়িত। যাঁরা চিঠি দিয়ে সিন্ডিকেট সভায় যোগ না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। অথচ সিন্ডিকেট সদস্যরা সবাই বর্তমান সরকার ও জুলাই চেতনা ধারণ করা ব্যক্তি।’
উপাচার্য বলেন, ‘শনিবার আমাদের সিন্ডিকেটের জরুরি সভা ছিল। ১০ জন সদস্য নিয়ে আমরা সফলভাবে সভাটি করেছি। কয়েকজন ভার্চ্যুয়ালি যোগ দেয়। এ সময় ২০-২৫ জন শিক্ষার্থী আমার বাসভবনের ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে নানা কুরুচিপূর্ণ স্লোগান দেয়। বুলডোজার দিয়ে বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া, আগুন দেওয়ার হুমকি দেয়। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পরই একাডেমিক ও প্রশাসনিক মানোন্নয়নের চেষ্টা করছি। মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি, দেখা করেছি। ইউজিসির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছি।’
শুচিতা শরমিন বলেন, ‘কতিপয় শিক্ষার্থীকে দিয়ে হঠাৎ গত বৃহস্পতিবার যখন আমার অফিস ও বাসভবনের গেটে তালা দেওয়ানো হলো, তখন শিক্ষার্থীদের সুনির্দিষ্ট কোনো দাবি ছিল না। পরদিন তাদের একটা দাবি পেলাম যে তারা ছাত্র সংসদ নির্বাচন চায়। আমি কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছি। তারা বলেছে, ওই শিক্ষার্থীদের তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। আমি বললাম, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের বিধান নেই। দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি হয়ে থাকে, তাহলে আমাকে জানাও। সেই অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নিতে পারব।’
উপাচার্য সাংবাদিকদের বলেন, সিন্ডিকেট সদস্য আসে মন্ত্রণালয় ও আচার্যের মাধ্যমে। ইতিমধ্যে তাঁরা নতুন চারজন সিন্ডিকেট সদস্য পেয়েছেন। এর মধ্যে রেড ক্রিসেন্টের চেয়ারম্যান, এনসিটিবির চেয়ারম্যান, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন অধ্যাপক আছেন। তাঁরা সবাই বর্তমান সরকার ও জুলাই চেতনা ধারণ করা ব্যক্তি।
বাসভবনের ফটক ভেঙে হুমকি দেওয়ার ঘটনাটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে করা হয়েছে অভিযোগ করে শুচিতা শরমিন বলেন, ‘কোনো ধরনের ইস্যু ছাড়াই এটা করা হয়েছে। এর পেছনে তিনজন ব্যক্তি জড়িত। যাঁরা চিঠি দিয়ে সিন্ডিকেট সভায় যোগ না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন।’ তিনি বলেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পরই থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কয়েকজন ব্যক্তি নানা ইস্যু তৈরি করে কিছু শিক্ষার্থীকে উসকে দিচ্ছেন। কিন্তু আমি যত দিন আছি, নিজে অন্যায় করব না এবং কারও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেব না।’
অভিযোগের বিষয়ে সহ–উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম রব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত ও নানা দাবি নিয়ে আন্দোলন করছেন। এখানে তাঁর সংশ্লিষ্ট থাকার কথা নয়। বরং তাঁরা শিক্ষার্থীদের দাবি ও সমস্যা নিয়ে কাজ করতে চান। উপাচার্যসহ তাঁরা যে তিনজন আছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে একসঙ্গে বসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে বিষয়টির সমাধান করা যেত।
অভিযোগের বিষয়ে কোষাধ্যক্ষ হারুন অর রশিদ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সিদ্ধান্ত উপাচার্য একাই নিয়ে থাকেন। আমি আসার পর আমাদের কোনো সভায় ডাকেন না। কোনো সিদ্ধান্তে আমাদের মতামত নেওয়া হয় না।’