‘চোখের সামনে ছেলেটাক মারি ফেলাইল, এলা আমাক কায় দেখিবি’

ছেলে তৌহিদুরকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় আহাজারি করছিলেন মা তাহমিনা বেগম। আজ সকালে দিনাজপুর সদর উপজেলার সাহেবগঞ্জ জঙ্গলপাড়ায়ছবি: প্রথম আলো

‘ছেলেটা দোকানত কাজ করোছিল, সেইখান থাকি ডাকি নিয়া যায় হাত-পা বান্ধিয়া চোখের সামনত আমার ছেলেটাক ডাঙ্গে (পিটিয়ে) মারি ফেলাইল। কতবার নিষেধ করনু। জেলখানাত দিবার কনু, কথায় শুনিল নাই। এলা (এখন) আমাক কায় দেখিবি।’ আজ শনিবার সকালে ছেলের জন্য এভাবে আহাজারি করছিলেন চোর সন্দেহে পিটুনিতে নিহত তৌহিদুর রহমানের মা তাহমিনা বেগম।

নিহত তৌহিদুর রহমান ওরফে বাংড়ু (৩৫) দিনাজপুর সদর উপজেলার কাউগা সাহেবগঞ্জ জঙ্গলপাড়া গ্রামের মৃত মেহরাব আলীর ছেলে। পেশায় ট্রাক্টরচালক ছিলেন। এ ছাড়া হোটেলে শ্রমিকের কাজও করতেন। গতকাল শুক্রবার স্থানীয় সাহেবগঞ্জ বাজারের একটি খাবার হোটেলে কাজ করছিলেন তিনি। এ সময় তাঁকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেন স্থানীয় কয়েকজন।

আজ সকাল ১০টায় তৌহিদুরের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আত্রাই নদীর বাঁধের নিচে টিনের চালাযুক্ত একটি দুই কক্ষের বাড়ি। এখানেই প্রতিবন্ধী মা ও এক সন্তানকে নিয়ে বসবাস করতেন তিনি। বড় ছেলেকে নিয়ে তাঁর স্ত্রী ঢাকায় পোশাক কারখানায় কাজ করেন। প্রতিবেশী আর স্বজনেরা বাড়িটিতে ভিড় করেছেন। তাঁরা তৌহিদুরের মরদেহের অপেক্ষায় ছিলেন। তখনো মরদেহ মর্গ থেকে আনা হয়নি। তাঁদের অনেকেই মা তাহমিনা বেগমকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।

ঘটনার প্রসঙ্গে তৌহিদুরের মা তহমিনা বেগম জানান, গতকাল দুপুরে জানতে পারেন, তাঁর ছেলেকে পাশের পাড়ার জাহাঙ্গীর ও তাঁর জামাতা রেললাইনের ধারে খুঁটিতে বেঁধে পেটাচ্ছেন। দ্রুত সেখানে গিয়ে ছেলেকে না মারার অনুরোধ করেন। কিন্তু কথা না শুনে তখনো তৌহিদুরকে পেটানো হচ্ছিল। মারপিটের একপর্যায়ে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ফেলে চলে যান মারধরকারী ব্যক্তিরা। পরে স্থানীয় এক যুবকের সহযোগিতায় ছেলেকে বাড়িতে নিয়ে আসেন মা তাহমিনা। এর কিছুক্ষণ পরই অবস্থার আরও অবনতি হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।

এ ঘটনার দুই দিন আগে জাহাঙ্গীর হোসেনের মাছ ধরা জাল ও শ্যালো পাম্পের তার চুরি হয় বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিদের কয়েকজন। তাঁরা জানান, চোর সন্দেহে তৌহিদুরকে ওই হোটেল থেকে সকাল নয়টার দিকে চুনিয়াপাড়ায় ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জাহাঙ্গীর হোসেনের জামাতা জহুরুল ইসলাম তাঁকে মারধর করেন। পরে সেখান থেকে মালিবাসা আমবাগানে নিয়ে আরেক দফা মারধর করা হয়। এর মধ্যে ঘটনাস্থলে আরও দুজন এসে মারধর করতে করতে রেললাইনের ধারে আনেন। সেখানেও তৌহিদুরকে মারধর করা হয়।

তৌহিদুরের ভাই ফারুক হোসেন বলেন, ‘জাহাঙ্গীর সব সময় এলাকায় ক্ষমতা দেখায়। আমার ভাইয়ের কাছে চুরির মালামাল পেল না, অথচ চোর সন্দেহে এভাবে পিটিয়ে মারল। বছর দুই আগেও এলাকায় একজনকে মারপিট করেছিল জাহাঙ্গীর। আমার ভাইকে হত্যার বিচার চাই।’

এ ঘটনায় গতকাল রাতেই তৌহিদুরের মামাতো ভাই শাহিনুর ইসলাম বাদী হয়ে পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে ও কয়েকজনকে অজ্ঞাতপরিচয় দেখিয়ে একটি হত্যা মামলা করেছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করে দিনাজপুর কোতোয়ালি থানার উপপুলিশ পরিদর্শক নুরে আলম বলেন, তাঁর মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তাঁর শরীরের বিভিন্ন স্থানে মারধরের চিহ্ন পাওয়া গেছে।